আত্মসংবৃতি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিশুর মেধা বিকাশে চিত্রকলার অবদান
সালমা জাকিয়া বৃষ্টি
আত্মসংবৃতি বা অটিজম স্নায়ুর বিকাশগত একটি সমস্যা যা সামাজিক যোগাযোগ বা ভাষা প্রকাশের সমস্যাসহ আচরণের ভিন্নতার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর মানসিক অবস্থা একজন শিশুর স্বাভাবিক ক্রমবিকাশ থেকে ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি বয়সে শিশুর যে স্বাভাবিক আচরণ ও বিচারবুদ্ধি থাকে অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশু তা থেকে ভিন্নতর আচরণের অধিকারী হয়ে থাকে। একই সাথে দক্ষতার ক্ষেত্রেও এধরনের শিশুরা ভিন্নভাবে সক্ষম। এই কারণে অটিজম বৈশিষ্ট্যের শিশুদের সাথে যোগাযোগ বা কর্মপরিচালনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। প্রকৃতপক্ষে, অটিজম কোন রোগ নয়, তাই এর চিকিৎসা বলতে শিশুর সমস্যার ধরন অনুযায়ী উপশমের বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় যা থেরাপি নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে শিশুর যেসকল বিষয়ে ঘাটতি থাকে তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। অটিজমের চিকিৎসায় প্রচলিত থেরাপির মধ্যে রয়েছেঃ ১) আচরণ বিশ্লেষণভিত্তিক বা Applied Behavioral Analysis (ABA); 2) কথা ও ভাষাভিত্তিক থেরাপি বা Speech and Language Therapy; 3) সংবেদনশীলতা থেরাপি বা Sensory Integration Therapy; 4) পেশাভিত্তিক থেরাপি বা Occupational Therapy, ইত্যাদি । এছাড়াও বর্তমানে সোস্যাল স্টোরি , পেক্স , মিউজিক থেরাপি, প্লে থেরাপি ও আর্ট থেরাপি প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আর্ট থেরাপিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হলেও বাংলাদেশে এর পদ্ধতিগতভাবে প্রয়োগ তেমনভাবে দেখা যায় না। অথচ যথাপোযোগী প্রয়োগের মাধ্যমে আর্ট থেরাপি অটিজম শিশুর মানসিক অবস্থার উন্নয়ন ঘতাতে পারে, উদাহরণস্বরূপ আর্ট থেরাপির মাধ্যমে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ‘আভিন’-এর মানসিক বিকাশের ঘটনা নিন্মে উপস্থাপন করা হল।
‘আভিন’ একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিশোর । অটিজমের পাশাপাশি তার উচ্চমাত্রার ‘মনোযোগ ঘাটতি অতিসক্রিয়তা ব্যাধি’ বা Attention deficit hyperactivity disorder (ADHD) রয়েছে। যার কারণে বেশিরভাগ সময়ই সে প্রচন্ড অস্থির থাকে। একই সাথে তার মানসিক জড়তার মাত্রাও বেশি। আভিনের বর্তমান বয়স ১৮ হলেও আচরণের দিক থেকে এই বয়সের অন্যান্য নিউরোটিপিক্যাল শিশু-কিশোরের চাইতে সে অনেকটাই পিছিয়ে। যাই হোক, প্রাথমিক পর্যায়ে তার ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ ছিল না। তবে ছবি আঁকার রঙ পেলে সে বিভিন্ন জায়গায় মাখাতে পছন্দ করত । তার রঙ মাখানোর আলাদা একটি ধরন লক্ষ্যনীয়; অনেকটা বৃত্তের মতো হাত ঘুরিয়ে মাখাতো। তাই আভিনের রঙ মাখানো স্টাইলকে মাথায় রেখে বিভিন্ন রকম ছবি আঁকার পরিকল্পনাসহ নানান মাধ্যমে আগ্রহী করার চেষ্টা করা হয়।
মূলত অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন চিত্রশিল্পী স্টিফেন উইল্ডশায়ার (১৯৭৪), নাদিয়া চোমিন (১৯৬৭-২০১৫), কিংবা ঝিল ত্রেহিনের (১৯৭২) জীবনের গল্পগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তাদের শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পিছনে পরিবার, শিক্ষক বা অন্য কারোর ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ উপযুক্ত সহযোগিতা থাকলে তাদের মেধা বিকশিত হতে পারে। তবে আভিনের ক্ষেত্রে একটা বিষয় সম্পূর্ণভাবে ভিন্নতর; উল্লেখিত শিল্পীদের প্রায় প্রত্যেকেই নিজে থেকে ছবি আঁকতে ভালবাসত যা প্রাথমিক পর্যায়ে আভিনের মধ্যে ছিল না। এমনকি শুরুর দিকে আভিন ছবি আঁকার সময়ে বিরক্ত প্রকাশ করতো। প্রকৃতপক্ষে, শিল্পের যেকোনো মাধ্যমের সংস্পর্শ মানুষের অস্থিরতা–উদ্বিগ্নতা কমাতে সাহায্য করে। এ ধারণার ভিত্তিতে প্রায় ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন ভাবে ছবি আঁকার বিষয়ে আভিনকে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। বস্তুত, ছবি আঁকার ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর জন্যই আলাদা পরিকল্পনার প্রয়োজন যা ঐ শিশুকে পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতেই করা উচিত।
দুই-তিন বছর বয়সে আভিন কে পেন্সিল ও কাগজ দেওয়া হলে সে কোনো দাগ দিতে চাইত না বরং ঐটাকে ঘুরানোর চেষ্টা করত। তখন তার হাতের উপর হাত রেখে দাগ দেয়ানো যেত যদিও এই কাজে সে খুব বেশি খুশি হত না। হাতে রঙ মেখে ছাপ দিলেও ওর কোনোরকম উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ছিল না। চার থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কাগজে অল্প কিছু দাগ দিত, তবে খুব অল্প সময়ের জন্য। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাগজ ও রঙ দেয়া হলেও কখনও ছবি আঁকার বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হত না। টিউব বা কৌটার রঙ পেলেই তা ফেলে দিত অথবা বিভিন্ন জায়গায় মাখাতে পছন্দ করত। উল্লেখ্য যে, কাল ও নীল রঙ পেলে ও অনেক বেশি অস্থির হয়ে যেত এবং অনেকক্ষণ অশান্ত হয়ে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করত। এই বিষয়টির কারণ খুঁজতে শুরু করলে দেখা যায় যে, এই দুই রঙের পোশাক অন্যান্য রঙের পোশাকের চাইতেও অনেক বেশি পছন্দ করে। অর্থাৎ তার পছন্দের রঙ বলেই হয়ত বেশি অস্থির হয়ে উঠে। তাই প্রথমে এই রঙ গুলো কে কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রাখতে হয়েছিল। এরপর আবার নীল ও কালো রঙ অল্প করে দিতে শুরু করা হলে দেখা গেছে আভিন অন্যান্য রঙের মতই কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়া এ দুটো রঙ দিয়ে ছবি আঁকছে। এগুলো আভিনের একধরনের বৈশিষ্ট্য যা হয়তো অন্য শিশুর মাঝে দেখা যাবে না। তাই আভিনের জন্য যেভাবে কাজ করানো হয়েছে অন্য শিশুর ক্ষেত্রে তা উপযুক্ত নাও হতে পারে। এরকম অনেক বৈশিষ্ট্য যা আভিনের একান্ত নিজের এবং এর উপর ভিত্তি করেই তার সাথে কাজ করার চিন্তা করতে হয়েছে। যার কারণে তার মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে তার সাথে যোগাযোগের কৌশল। পাশাপাশি তার জন্য বিভিন্ন কর্ম পরিকল্পনা করার কারণে নানারকম পরিক্ষা-নিরিক্ষার আশ্রয় নিতে হয়। ফলস্বরূপ, আভিনের ছবি আঁকার অভ্যাস গড়ে উঠার পাশাপাশি তার মনোযোগের ঘাটতি ও অস্থিরতা অনেকাংশে কমেছে।
গত ১৫ বছরের প্রয়াস, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার কলাকেন্দ্রে, ‘দ্বৈবিধ্য’ শিরোনামে প্রদর্শনীর মাধ্যমে আভিনের শিল্পচর্চার জগতটি যা পেন্সিল, প্যাস্টেল, অ্যাক্রেলিক রঙ, কোলাজ, কাগজের মন্ড ও মিশ্র মাধ্যমে করা তার বিভিন্ন বয়সের কাজের কিছু অংশ উপস্থাপিত হয়। মূলত আভিনের বিভিন্ন বয়সের ভিন্ন ভিন্ন কাজগুলো তার বিশেষ কোনো বিষয়ের উন্নতি বা বিকাশের লক্ষ্যেই করা হয়েছিল। যেমন অস্থিরতা কমানো, দৃষ্টিসংযোগ উন্নত করা, মনোযোগ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। শিল্পচর্চার সাথে আভিনের এই যাত্রাটি অনেক সম্ভাবনাময়। সঠিক উপায়ে পরিকল্পনার সাথে শিল্পচর্চার মাধ্যমে বিশেষভাবে সক্ষম এই শিশুদের জীবনযাত্রা অনেকটা সহজ হতে পারে বলে আশা করা যায়।
তারিখ: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫



AstuteHorse