করোনার সাথে একরাত্রি
ইভান অনিরুদ্ধ
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। রাত একটা বাজে। ফেসবুকে শেষ স্ট্যাটাস দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণ পর আমার ঘরের জানালায় ঠক ঠক আওয়াজ। অবাক হলাম, ঝুম বৃষ্টি আর করোনা ভাইরাস আতংকের ভেতর কে হতে পারে এতো রাতে! আলগোছে জানলাটা একটু খুলে জিজ্ঞেস করলাম-
-কে? কে এখানে?
-ভাই, আমি করোনা।
-মানে?
-আমি করোনা, আই মিন আমি ভাইরাস করোনা!
-কী মশকরা শুরু করলেন!
-বিলিভ মি, মশকরা করছি না। আমি সত্যিই করোনা।
-আচ্ছা, বিশ্বাস করলাম। তা আমার কাছে কী?
-আমাকে বাঁচান, প্লিজ। সেইভ মাই লাইফ, আই অ্যাম ইন ডেনজার!
-কী সমস্যা?
-আগে আমাকে ভেতরে আসতে দিন।
-সরি, এটা সম্ভব না। দেখছেন না কী হারে আমাদের দেশে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে আর মরছে!
-কথা দিচ্ছি আর কোনো বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হবে না। বড় ভুল করে ফেলেছি এই পিকিউলিয়ার দেশে এসে! আমি এখন নিজের জান নিয়ে পালাতে চাই এদেশ থেকে।
-হা,হা,হা। তা আমার কাছে কী?
-ভাই, কেবল রাতটা থাকতে দিন। এই দেশের পাবলিক যেভাবে আমার ওপর ক্ষেপেছে, আমাকে হাতের কাছে পেলে পিটিয়েই মেরে ফেলবে। প্লিজ, দরোজাটা খুলেন। তাছাড়া এরকম ফাউল বৃষ্টি আমার লাইফে পাইনি, ডিজগাস্টিং!
-সরি, আমি কিছু করতে পারবো না।
-ভাই, আপনার পায়ে ধরি। আমার এইদেশে আসা চরম ভুল হয়ে গেছে। আপনারা যে বীরের জাতি- এটা এখানে এসে জেনেছি। আমার উচিত ছিল এই দেশের পাবলিকের প্রোফাইল ভালো করে জেনে বর্ডার ক্রস করা।
-তুমি শালা আসলেই ফাউল। পুরা দেশটাকে তছনছ করে দিয়েছ। কী যে বেড়াছেড়া অবস্থা করেছো। ইউ শুড বী পানিশড!
-ভাই কষ্টের মাঝেও হাসি পাচ্ছে আমার।
-কেন?
-আচ্ছা ভাই, আপনাদের চরিত্র এইরকম ক্যান? পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষের চরিত্রের সাথে একবিন্দু মিল পেলাম না। মানুষের তো কিছু বেসিক ক্রাইটেরিয়া থাকে, তাই না? আপনাদের সেই মিনিমাম ক্রাইটেরিয়াই নাই।
-হা,হা,হা।
-হাসবেন না প্লিজ। আমি এখন শান্তিপূর্ণ এক্সিট চাই এইদেশ থেকে। অসহ্য লাগছে সবকিছু।
-তাই নাকি?
-হ্যা, তাই। এখন নিজেকে প্রশ্ন করি- এই বাঙ্গালিকে কে বানিয়েছে? ওপরওয়ালা নাকি অন্য কেউ?
-হা,হা,হা।
-হাসেন, মন-প্রাণ খুলে হাসেন। ইচ্ছে হলে জামাকাপড় খুলে হাসেন। তবে যা সত্যি, আমি কিন্তু তাই বললাম। আমার করোনা নাম ভাঙ্গিয়ে এই দেশে কী না হচ্ছে! মনে হচ্ছে এই দেশের জনগণ আমার আগমনের অপেক্ষাতেই ছিল। আমি আসাতে তাদেরকে আতঙ্ক নয়, মহা আনন্দ জাপটে ধরেছে। এ্যানিওয়ে, আপনি কি আমাকে ঘরে ঢুকতে দিবেন নাকি চলে যাব? এতোক্ষণ কি কেউ কাউকে ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড় করিয়ে রাখে?
-সরি, সরি। দরোজা খুলে দিচ্ছি। তবে ঘরে ঢুকে কিন্তু অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
-হা,হা,হা। কী সুন্দর কথা! আপনাদের মুখে এক কথা, অন্তরে আরেক কথা।
-কেন?
-রাস্তাঘাট, হাটবাজার, মোড়ে মোড়ে চায়ের স্টলের দিকে তাকান তাহলেই তো আমার কথার উত্তর পাওয়া যাবে। পৃথিবীর সব দেশেই দেখলাম বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকার যা নির্দেশ দিয়েছে, জনগণ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। অথচ এইদেশে সম্পূর্ণ বিপরীত।
-বুঝতে পারছি আমাদের দেশে এসে আসলেই তুমি হতাশ এবং কনফিউজড।
-একদম, একদম। এইদেশে যে কতশত ধান্দাবাজ- তা আমি না এলেই বুঝতেই পারতাম না!
-কেন?
-পৃথিবীর কোথাও এখন পর্যন্ত আমাকে প্রতিহত করতে ওষুধ আবিস্কার হয়নি অথচ নেত্রকোনা নামে একটা জেলার কেন্দুয়া থানায় মাইকিং করে দুইজন করোনার ওষুধ বিক্রি করছে বাজারে। এতে আমি কিন্তু নিজেকে খুব অপমানিতবোধ করেছি। আপনার কি মনে হয়- আমি এতোটাই তুচ্ছ যে, গ্রামের একজন ধান্দাবাজ কবিরাজ আমার প্রতিষেধক বানিয়ে ফেলেছে?
-তোমার কথা ঠিক।
-সামান্য পাঁচ টাকার জিনিস আমার নাম করে পঞ্চাশ টাকা করা হয়েছে। রাতারাতি কিছু কোম্পানি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম আকাশছোঁয়া করে ফেলেছে, কেউ কেউ নেমে পড়েছে সার্জিক্যাল মাস্কের স্টক বিজনেসে। কত জঘন্য মানসিকতা! আপনাদের এসব কর্মকাণ্ড দেখে আমিই লজ্জায় পড়ে গেলাম।
-তোমার কথা মিথ্যে নয়। আমাদের ভেতর কিছু ধান্দাবাজ লোক এই কাজটি করেছে।
-কেন এরকম করবে এরা? এদের কি মৃত্যুভয় নেই? এরা কি একবারো ভাবেনি যে, যখন-তখন যেকেউ করোনায় আক্রান্ত হতে পারে, যেকেউ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে মরে যেতে পারে?
-এরা ভেবেছে ঠিকই কিন্তু তার আগে বেশি ভেবেছে- এখনই তো আর আমাদের করোনা ধরছে না, তাই আগে কিছু ব্যবসা করে কিছু টাকা কামিয়ে নিই।
-আমি যখন চায়না থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় আক্রমণ বাড়াচ্ছিলাম তখন কিন্তু আপনাদের দেশ পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিল আমাকে মোকাবেলা করার জন্য, যথেষ্ট সময় ছিল একটা সমন্বিত প্রস্তুতি নেওয়ার। কিন্তু কিছু ব্যাক্তি, কিছু নেতা সরকার প্রধান এবং জনগণকে মিসগাইড করেছে। কেউ বলেছে- করোনা সাধারণ সর্দি-কাশি, কেউ বলেছে তারা করোনার চেয়েও শক্তিশালী। হা,হা,হা। দিস ইজ কল্ড শিয়ার স্টুপিডিটি!
-ইউ আর রাইট, অ্যাবসলিউটলি রাইট।
-আমি তো চলেই যাচ্ছি। তবে আমি কিছুদিনের জন্য আপনাদের দেশে এসে সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি- এই দেশের স্বাস্থ্যখাতটা কতো নড়বড়ে, ভেতরটা কতো ফাঁপা। অথচ দেশের আনাচে-কানাচে কান পাতলেই শোনা যায় কেবল উন্নয়নের রাগিণী। আঠারো কোটি জনসংখ্যার একটি দেশে সবার আগে উচিত স্বাস্থ্যখাতকে ঠিক করা, হাসপাতাল গুলোর অব্যবস্থাপনা দূর করা, সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যাওয়া। আমি দেখলাম, আপনাদের টাকার অভাব নেই, অভাব কেবল সৎ এবং দেশপ্রেমিক লোকের যারা সরকার প্রধানের নির্দেশনা জনগণের স্বার্থে বাস্তবায়ন করবে। যাক, অনেক কথা বলে ফেলেছি। আমার কী দায় পড়েছে যে আপনাদেরকে নীতিবাক্য শোনাবো!
-নীতিবাক্য না, তুমি যা বলেছ তা বাস্তব। একবিন্দু বাড়িয়ে বলোনি। আসলে আমরা সাধারণ মানুষ হলাম ক্ষমতাহীন। যারা দেশ চালায় তারা যদি করোনার মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ভুলগুলো সংশোধন করে তাহলেই দেশের মঙ্গল, দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন।
-ভোর হতে বেশি দেরি নেই। এখনই বেরিয়ে পড়ব। সারারাত বকবক করেছি। গলাটা বসে গেছে। এক কাপ চা বা কফি হবে আপনার পক্ষ থেকে?
-হবে, আদা-চা। এটা বসে যাওয়া গলার জন্য বেশ উপকারী।
-এক কাপ, প্লিজ!
-শিউর!
-চা হতে হতে আরেকটা কথা বলি?
-বলো।
-আপনাদের দেশের ত্রাণ চোর, চাল চোরদের কি বড় ধরনের কোনো শাস্তি হবে? এরা না জনপ্রতিনিধি! তাহলে এরা কেন অসহায় জনগণের ত্রাণ বা সাহায্যসামগ্রী লুট করে খায়? এদের কি কোনো মনুষত্ববোধ নেই? এরা দেখছি আমার থেকেও খারাপ!
-আচ্ছা, আমরা সংবাদ সম্মেলন করে কবে বলতে পারবো, বাংলাদেশ এখন করোনা মুক্ত।
-আপনাদের কষ্ট করে এই কথা বলতে হবে না। আমি করোনা নিজেই তো আপনাদের এইসব সার্কাস দেখে বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছি। এ এক অদ্ভুত দেশ! কেউ কাউকে মানে না, কেউ কারো কথা শোনে না। সরকার ডানে যেতে বললে পাবলিক যায় বাঁয়ে!
-সত্যি যাচ্ছ নাকি আবার দুদিন পরে এসে হাজির হবে?
-মাথা খারাপ! আবার আসবো এই দেশে? নেভার এভার! সারা দুনিয়ায় আমি আক্রান্ত করেছি লক্ষ-কোটি মানুষকে। আর এখানে বীর বাঙ্গালি এখন আমাকেই আক্রান্ত করে ফেলছে, আমাকেই আইসোলেশনে পাঠাতে উঠেপড়ে লেগেছে। হা,হা,হা।
ভোরের আজানের সুর ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। কিছুক্ষণ পর সকাল হয়ে যাবে। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। আমি অলস ভঙ্গিতে বিছানা থেকে উঠে জানালাটা খুলে দিয়ে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মাথাটা কেমন যেন হাজার কথার চাপে ভার হয়ে আছে।
মনে হল, আজকের এই মেঘলা সকালটা অন্যদিনের সকালের মত না। মনে হল, আজকের সকালটা করোনামুক্ত একটা ফুরফুরে সকাল! আজ থেকে যেন আমাদের দেশটা করোনামুক্ত চিরচেনা সেই লাল-সবুজের দেশ!
তারিখ: নভেম্বর ৯, ২০২১

 

AstuteHorse