ছোটদের আঁকার ক্লাসের গল্প

 

টেক্সাসের একটি জায়গার নাম স্যান মার্কোস। সেই স্যান মার্কোসের ওয়ান্ডারল্যান্ড নামের একটি স্কুলে আমি ছোটদের ছবি আঁকা শেখাই। শেখাই, ছোটদের কাছে শিখি এবং একসঙ্গে ছবি আঁকি বললে কথাটা আরেকটু পরিস্কার হবে। ছোটরা চাইলে অনর্গল কথা বলে যেতে পারে এ আমাদের জানা। কিন্তু ছবি আঁকার ক্লাসে আমরা যে কি ভীষণ কথা বলি, তা নিয়ে বড়জোর দু-এক কথা এই সংক্ষিপ্ত লেখায় প্রকাশ করতে পারব।

পাঠভবনে গাছের তলায় বসে ছবি আঁকার যে ক্লাস করতাম, সেটা ছিল ভারী আনন্দের। এখন আমি কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণীদের যখন ছবি আঁকা শেখাই, তখন সেই আনন্দ আর স্বাধীনতাই আমার ছেলেমেয়েদের কাছে তুলে ধরি। ওয়ান্ডারল্যান্ডের ছেলেমেয়েরা ক্লাসরুম ছেড়ে ইদানিং গাছের তলায় খাতা, রঙ নিয়ে মহা আনন্দে মাঝে মাঝে ক্লাসও করে থাকে। এবং তারাও আমারই ছোটবেলার মত গাছের তলায় বসে ছোট ছোট পাথর ছোড়ে, কাদা পেলে আঙ্গুল ডুবিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাদা কাগজে রেখা টানে। জামার মধ্যে শুকনো পাতা ভরে খড়মড় আওয়াজে একাএকাই হাসে।

আঁকার ক্লাসের অনেকটা সময় আমার যায় ছোটদের কথা শুনে। তার বেশীরভাগ কথার সঙ্গেই হয়ত সরাসরি ছবির কোনো যোগাযোগ নেই। তবে কথাগুলো ওদের কাছে খুব গুরুত্বপুর্ণ, কাজেই আমিও মন দিয়ে শুনি। হয়ত কারো দাঁত পড়ে গিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছে, কারো দিদিমা গতকাল আসবেন বলে আসতে পারেননি, কারো কুকুর মারা গিয়েছে, অর্থাৎ একজন কেউ মন খারাপের কথা যদি বলে এবং শিক্ষিকা সমবেদনা জানায় তাহলে সকলেই কোনো না কোনো দুঃখের কথাই বলতে থাকে। পরে হয়ত জানতে পারি কোনটা গতকাল ঘটেছে, কোনোটা আবার গত বছর। কোনোটা হয়ত ঘটেইনি।

আবার কোনোদিন কেউ বলে উপহার পাবার গল্প, কেউ বলল বেড়াতে যাবার গল্প, কেউ বলল পছন্দের খাবারের গল্প, সেদিন কেবলিই সুখবরের ছড়াছড়ি।

কোভিডের মত মহামারির অভিজ্ঞতার ফলে ছোটদের মনের মধ্যে নানান দুশ্চিন্তা এবং আশঙ্কা বাসা বেঁধেছে । এই গল্প করার মধ্যে দিয়ে তার অনেক কিছু প্রকাশ পায়। আমি এই পরিস্থিতি মাথায় রেখেই ছোটদের সঙ্গে আরো অনেক বেশি আলোচনা করি এবং বিশেষত ওদের কথা শুনি।

যে ছবি আঁকল তা নিয়েও কম কথা হয় না। যা চোখে দেখা যায় তার থেকেও বেশি গল্প ছবিতে লুকিয়ে থাকে। একদিন প্রথম শ্রেণীর বাচ্চারা স্কুলে এসে কি কি দেখে, তা আঁকতে গিয়ে কেউ আঁকল টেবিল চেয়ার, কেউ আঁকল বন্ধুরা হাত ধরে খেলছে । এডেন অসম্ভব কাছ থেকে আঁকল তার ও তার বন্ধুদের খাবারভর্তি লাঞ্চবক্সের মধ্যেটা, তারপর শুরু হল গল্প – এই খাবারের মধ্যে দিয়ে দিয়ে এডেন কেমন করে হেঁটে চলেছে ইত্যাদি।

এছাড়াও নামকরা নানান দেশের শিল্পীদের কাজ দেখা এবং তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিণ্ডারের সোফিয়া, ভিন্সেন্ট ভ্যান গখের নানান দুঃখের কথা শুনে ও তার ছবি দেখে, তাড়াতাড়ি করে এঁকে ফেলল একটা রাতের আকাশ। এবং বলল ভ্যান গখ এর স্টারি নাইট কেই আবার করে সোফিয়া এঁকেছে আর তার মধ্যে ভ্যান গখকেও এঁকে হাতে একটা আইস্ক্রিম দিয়েছে। নিজের ছবিতে নিজেই ঘুরতে ঘুরতে আইস্ক্রিম খেলে উনি নিশ্চয়ই আনন্দ পাবেন! আপাতদৃষ্টিতে বড়দের চোখে – ঘন নীল রঙ, কিছু হলুদ ফুটকি আর কয়েকটা রেখা জোড়া, যা মানুষ হলে হতেও পারে এমন ছবি ধরা পড়লেও সোফিয়া অনেক কিছু ভেবেছে, দেখেছে  এবং আমাদের দেখাচ্ছে এই কথা আমার কাছে সর্বদাই গুরুত্ব রাখে।

পাঠভবনে আমার শিক্ষকরা আলোচনা করতেন। জানতে চাইলে বুঝিয়ে দিতেন কিন্তু কি আঁকব কখনও বলে দিতেন না। কি আঁকব বলে দেবার জন্যে আকশে মেঘের আকার-আকৃতি ছিল। গাছের গুড়িতে নানান নক্সা ছিল। মওসুমি ফুলের রঙ ছিল, ছিল গাছের পাতার শীতে ও বসন্তে আলাদা আলাদা রূপ। পাখি, কাঠবেড়ালী, কুকুর, পিঁপড়ে আরো কত কি!

ওয়াণ্ডারল্যান্ড স্কুলে আমার ছাত্র-ছাত্রীরা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ক্লাস করে। প্রকৃতির সঙ্গে একটা দূরত্ব রয়েই যায় রোজকার জীবনে। একদিন ঠিক হল আমরা মাটি বা প্লেডো দিয়ে মা পাখি বানাবো আর একটা করে পাখির ডিম। পাখির বাসা বানাতে যা লাগবে তা আমরা বাইরে গিয়ে সংগ্রহ করব। ছোটো ছোটো বাটি হাতে প্রথম শ্রেণীর শিশুরা শুকনো পাতা, কাঠি, নুড়ি, ঘাস আর যা দরকারি মনে করল – সব যোগাড় করল। জোগাড় অবশ্যই অতিরিক্ত হল, বাটি উপচে পরল এবং ক্লাসরুম অব্দি সামলে আনতে আনতে তার অনেকখানি পথেই রয়ে গেল। উত্তেজনায় মা পাখি, ডিম সব কোনোমতে বানিয়ে এবার সবাই মুলত মন দিল ডিম ফুটে পাখির ছানা বেরিয়ে কেমন করে ডাকবে, কেমন করেই বা একটু একটু উড়বে। একঘর প্রথম শ্রেনী তখন বিবিধস্বরে কিচিরমিচির করছে আর ছোট্ট ছোট্ট লাফ দিয়ে দু’হাত তুলে পরখ করছে ডানা মেলে উড়লে কেমন লাগে। ক্রমাগত গল্পও বানিয়ে চলেছে! এও তো একরকম কথা বলাই হল, মা পাখি হয়ে কথা, ছানা পাখি হয়ে কথা, পাতা, ধুলো, কাঠির মধ্যে হাত বুলোতে বুলোতে কথা!

হকুসাই-এর দ্য গ্রেট ওয়েভ ছবিটি দেখার পর নিজেরা একটা মস্ত বড় ঢেউ আঁকবে ঠিক করল তৃতীয় শ্রেণীর বাচ্চারা। ঢেউ কিছুতেই কাগজজুড়ে হচ্ছে না –খুব ছোট আকার হয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম সবাই নিজেরা ঢেউ এর আকৃতিতে ক্লাসরুমে ঘুরে বেড়াব, কেউ হাত উর্ধে তুলে, কেউ গোল পাকিয়ে, কেউ বা শুয়ে পড়ে নানান আকৃতি তে হয়ে গেল মস্ত মস্ত ঢেউ । সে ঢেউ কখনো হাল্কা দুলছে আবার কখনও যেন সমুদ্রে ঝড় উঠছে! এরপর জলরঙে বড় বড় তুলির আঁচড়ে সেদিনের “গ্রেট ওয়েভ”রা কাগজের সীমা ছেড়ে বেরিয়ে যায় আর কি!

নাটক, অভিনয়, নিজেদের গল্প, অন্যের গল্পকে আশ্রয় করে কল্পনার জগতে দিব্যি চলে যায় ছোটোরা। এসব করতে মুখোশ, পাপেট এবং ছায়া পুতুল বা শ্যাডো পাপেট আমাদের অন্যতম ভরসা – পুতুল বা মুখোশ বানাবার দক্ষতা আর নৈপুণ্য যেমন হোক না কেন, তার সঙ্গে থাকে একরাশ গল্প। উত্তেজনায় কে যে অভিনয় করবে আর কে যে দেখবে সেই খেয়াল চলে যায় । কখনো সবাই একসঙ্গে ছায়াবাজি করতে শ্যাডো থিয়েটার বক্সের পিছনে চলে যাচ্ছে, পরক্ষনেই ছায়াবাজি দেখতে সবাই একসঙ্গে দর্শকের দিকে বেরিয়ে আসছে । তারপর ভুল-ভ্রান্তি কাটিয়ে, মন একটু শান্ত করে কে কোন চরিত্র করবে, কে অভিনেতা কে তখন দর্শক ধীরে ধীরে ঠিক হয়।

নানা স্বরে কথা, গান, অভিনয় এবং গল্প বানানো – এই আমি আমি, আবার আমি নই, অন্য কেউ – এই অন্য কেউ হয়ে যাবার মধ্যেও আসলে ফুটে ওঠে ছোটদের আনন্দ, স্বপ্ন, ইচ্ছে, আঘাত পাবার কষ্ট, অনিশ্চয়তা, একলা লাগা।

পাঠভবনে নানান শিল্পের পাঠ এবং সর্বোপরি বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতিকে চিনতে চিনতে একলা লাগলে গাছপালা আকাশ-বাতাস-বৃষ্টিকে আরো বেশি বন্ধু ভেবে চলতে শিখেছিলাম। তার একটুও যদি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের কচি মনে সঞ্চার করতে পারি তবে জানব শান্তিনিকেতন আমার সঙ্গেই রয়েছে।

ছোটোদের মনের খোঁজ পাওয়ার জন্যে ছবি আঁকা এক দারুন পদ্ধতি তার সঙ্গে আমরা যদি একটু ধৈর্যসহ ওদের কথা শোনায় সময় দিতে পারি, তবে এই অস্বাভাবিক অসুস্থ সময়ে শিশু মনের ব্যাথা, কষ্ট আমরা ভাগ করে নিতে পারব। শুধু তাই না, কত সহজে আর কি আনবিল আনন্দে যে জীবনকে ভরিয়ে রাখা যায় তাও এই সুযোগে ফিরে দেখা হয়ে যাবে।

গতকালের একটা গল্প বলে শেষ করি। প্রথম শ্রেণীর জেসি জলরঙ করতে করতে বলল – নীল আর হলুদ পাশাপাশি দিতেই মাঝে কেমন সবুজ রঙও হয়ে গেল। আমি বললাম – ওমা তুমি ভুলে গেলে রঙ কাঁচা থাকলে নীল আর হলুদ মিশলে তো সবুজ হয়ে যায়! ক্লাস শেষে চলে যাবার সময় জেসি আমায় বলে গেল – তুমি কতবার বললে নীল আর হলুদ মিশলে সবুজ হয় অথচ একবারও বললে না হলুদ আর নীল মিশলেও সবুজই হয়। পরে জানলাম জেসি অঙ্কের ক্লাসে এখন শিখছে ৫ আর ৩ এ যদি ৮ হয় তাহলে ৩ আর ৫ এও ৮ ই হবে। আমি আমার ভুল স্বীকার করলাম। শুরুতেই বলছিলাম, ছোটদের যেমন শেখাই তেমনি আমি প্রতিদিন শিখি। ছবি দিয়ে শিখি, গল্প দিয়ে শিখি, জীবন কে দেখার ধরন দিয়ে শিখি। আর ভুল-ত্রুটি ভরা আমাদের ছবি আঁকার ক্লাসগুলো রেখায় আর শব্দের কোলাহলে – আনন্দে স্বাধীনতায় ভরে ওঠে।

তারিখ: মার্চ ১, ২০২৫

প্রকাশক: সাবিহা হক, অধ্যাপক, ইংরেজি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

all rights reserved by - Publisher

Site By-iconAstuteHorse