থেরাপি হিসেবে কবিতা লেখা

মূল: লানা ডেরকাক

কবিতা লেখার কাজটা একটা থেরাপি। এই থেরাপি আমাদেরকে এই বিশ্ব সম্পর্কিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ও ব্যক্তিগত ইমেজ থেকে শুরু করে মহান ও বৈশ্বিক ইমেজগুলোকে অবিরামভাবে বয়ে বেড়ানোর এবং সেই ইমেজগুলোকে অগুন্তি ও অদ্ভুত সব রূপক (মেটাফর), উপমা (সিমিলি), অনুকার (ওনোমেটোপিয়া), সমাসোক্তি (পার্সোনিফিকেশন) ও নানান  অলংকারে রূপান্তরিত করার সক্ষমতা প্রদান করে। কারণ, কারও কোন রকম সম্মতি কিংবা স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র ছাড়াই আমরা প্রত্যেকে অবিরতভাবে এবং নিয়মিতই খেয়ালি মন আর দুশ্চিন্তা বয়ে বেড়াই। নিত্যনতুন প্রত্যাশ্যার জোয়ার আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় প্রতিনিয়তই, আর সেই জোয়ারই আমাদের মুক্তির উপায়গুলোকে গ্রাস করে ফেলে। আমাদের বয়ে বেড়ানো সেইসব প্রত্যাশার অরূপান্তরিত (আনরিসাইকেলড) চাপ টিভি সেটের সামনে বসে যুক্তিহীনতা আর মূর্খতার প্রভাবে আরও পুঞ্জীভূত হয়। আর অনিয়মিত ভাবে হলেও আমাদের সঙ্গী হয়ে উঠে অর্থহীনতার কষাঘাত কিংবা গতানুগতিকতার বিষাদ।

তবে থেরাপি হিসেবে লেখালেখির চর্চা করা প্রত্যেক কবিই এ বিষয়ে সচেতন যে, দুর্দশার জন্ম দেওয়া তো দূরের কথা ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ বয়ে বেড়ানোতেও সায় নেই তাঁদের। যদিও দু:খ-দুর্দশা আর কবিতার মধ্যে যে এক রকমের সন্ধি আছে সে ব্যাপারটা কবি মাত্রই বুঝতে পারেন। দুর্দশা থেকে পরিত্রাণের সম্ভাবনাগুলোকেও তিনি আঁচ করতে পারেন। আর সেই সাথে তিনি এও জানেন যে, সিসিফাসের মতন দূর্দশার পাথরটাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার কাজটা তাঁর কবিতার জন্য পুরোপুরিভাবে নিরর্থক-অপব্যয় নয়। সুতরাং, কবিতা এই সিসিফাস-কবির উপর একটি নতুন অর্থ প্রযুক্ত করতে পারে।  আর তাছাড়া সিসিফাসকে নিয়ে তো দেবতাদের অনেক পরিকল্পনাই ছিল; তাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা তার ব্যাপারে নেয়া সর্বশেষ কিংবা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। কে জানে, হয়ত পরবর্তীতে পুরস্কৃত করার জন্যেই তাকে ঐ শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।

এখানে বোধ হয় একটা স্ববিরোধিতা দেখা দিচ্ছে। ব্যাপারটাকে স্পষ্ট করে বলতে গেলে এমন বলা যায় যে, একজন একগুঁয়ে ও অবাস্তববাদী মানুষ নিজ  দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে থেকে হঠাৎ করেই খানিকটা মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। আর এই ধারণা থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, ব্যবহারিকতা ও ব্যবস্থাপনার  এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা কবি তাঁর নিজের মধ্যে ধারণ করেন। তবে এটি কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নয়, কারণ এখানে কেবল আত্মিক আয়-ব্যায়েরই হিসাব করা হয়। আর তাই বড় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কবি তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষয়-ক্ষতি ও সিসিফাসের মতন পাথর ঠেলার ব্যর্থতা থেকে একরকমের মুনাফা বের করে নিয়ে আসতে পারেন। এখানে মনে রাখতে হবে যে, সাহিত্য প্যারাডক্স ভালোবাসে।

এ কথা সত্য যে, কবিতা লেখার চর্চা হলো একরকম করে খাপ খাইয়ে নেবারর প্রচেষ্টা। কেননা কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে আর পরোক্ষভাবে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করা কিংবা তাকে মূর্তমান রূপে উপস্থাপনের মাধ্যমে কবি এই বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করেন। এই বিশ্বের মাঝে নিজের অবস্থানকে খুঁজে নেন। কিন্তু নিজস্ব ট্রমা ও অসম্মতিগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবি তাঁর নিজের লেখা কবিতাটির বলয়ের বাইরের এক রোগের সাক্ষী হন। মজার ব্যাপার হলো, এই রোগের জন্যে কবি নিজেই দায়ী। তবে একদম প্রাথমিক পর্যায়েই এই রোগটিকে চট করে চেনা যায় না, যদিও বেশ অনেকদিন ধরেই সেটি নববধূর মতন হাসি মুখে নানান পোজে ফটোশুট করে আসছিল। বাস্তবতার বৈশিষ্ট্যই হল যে, সে অবিচল ও অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু তবুও দৈবিক। এই বাস্তবতার অভিজ্ঞতা দ্বারা প্ররোচিত রোগটির উদ্ভব কিন্তু কবিতাটির উপর নির্ভরশীল নয়। তবে কবিতাটি এই রোগের উপর নির্ভরশীল এবং এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও।

ঠিক এমন মুহূর্তে, আর এমন অবস্থাতেই, পথ্য হিসেবে কবিতা এবং থেরাপি হিসেবে কবিতা লেখার চর্চার উদয় হয়। এই অবস্থায় নিজের কবিতার প্রতি ঋণী-কবি তাঁর লেখা কবিতার বদৌলতে নিজের মধ্যকার পরাজয়ের বোধটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন। নিজের ভেতর ভাল বোধ করতে শুরু করেন। আর মানসিক প্রশান্তি ও স্বল্পমেয়াদী আত্মিক পরিতৃপ্তির মধ্য দিয়ে নিজের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও খানিকটা বাড়িয়ে নিতে পারেন।

এই পর্যায়ে রয়েছে আরও একটি প্যারাডক্স। যেমন, রোগটির জন্ম কবিতাটির উপর নির্ভরশীল না হলেও, রোগটি কিন্তু কবিতাটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রোগটির অবাঞ্ছিত সব কোষ ও তার যে বিধ্বংসী বৈশিষ্ট্য আছে সেগুলোকে আমলে এনে কবিতাটি নিজে থেকেই এক সময় রোগটির বিনাশকারী হয়ে উঠে। দক্ষ হাতে ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে কবিতাটি তার কবিকে–তার নিজ স্রষ্টাকে–মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলে।

তাই কবিতা অথবা অন্য যে কোন সাহিত্য রচনা করার কাজটি সম্পূর্ণভাবে আত্মহত্যার বিপরীতধর্মী একটি কাজ। যখন আবেগের জনাকীর্ণ রাজত্বে অবিশ্বাস্যভাবে ছড়িয়ে থাকা শূণ্যতার মতন প্রচলিত ও অনুমোদিত অক্ষরসমূহ পুরোপুরি অপ্রচলিত উপায়ে কাগজের শূন্যতার ওপর ছেয়ে যায়, ঠিক সেই সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে হঠাৎ করেই ব্যাখ্যাতীত ও রাসায়নিক উপায়ে কাগজ আর কলম চিকিৎসাশাস্ত্রের অদৃশ্য পাতায় লেখা অবাস্তব বড়িগুলোর প্রধান উপকরণে পরিণত হয়। হঠাৎই এই কাগজ আর কলম রোগ উপশমের ক্ষমতা পেয়ে যায়।

লেখক তাঁর কাগজ-কলম কিংবা কম্পিউটার-কি-বোর্ড ব্যবহার করে খুঁটিনাটি সবকিছুর বিস্তর বর্ণনা দেন, আর তুচ্ছ ও অবাস্তব নানা বিষয় যেগুলো তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ সেসব নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকেন। এই সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তার আবেগের রাজত্বটিকে পরিপূর্ণ ভাবে দখল করে রাখে। আর এই উপকরণগুলো অবিশ্বাস্যরকম ক্ষমতাধর, যদিও তাদের মধ্যে দখলদারিত্বের কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের কোন চেষ্টাই থাকে না। তাই লেখক এই খুঁটিনাটি উপকরণগুলোকে  বিশ্বাস করেন। তবে এই উপকরণগুলো এমন যেগুলো এমনিতে কোন পাব্লিক প্লেসে উচ্চারিত হলে কেবল প্রলাপ হিসেবেই সাব্যস্ত হতো। এদেরকে বিশেষ বিশেষ জায়গায় বসিয়ে ধীরে ধীরে অনুপ্রাণিত কাব্য ও গল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়।  আর এই সাহিত্যকর্মগুলো হয়ে উঠে ব্যাংক, এয়ারপোর্ট, বিচারালয় ইত্যাদি গতানুগতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতই কার্যকরী, এমনকি হাসপাতালের মতনও। হাসপাতালে যেমন একটা শিফট শেষ হতেই  একদল সাদা এপ্রন পরিহিত ডাক্তারের পরিবর্তে আরেক দল ডাক্তারের ডিউটি শুরু হয় যাদের প্রত্যেকের গঠন-প্রকৃতি ও  ডিএনএ পরস্পরের থেকে আলাদা, তেমনি করে লেখকেরা তাদের লেখার উপকরণগুলোকে ব্যবহারের মাধ্যমে যেকোন সময় যেকোন রকমের চরিত্রকে রূপায়িত করতে পারেন। আর এই চরিত্রগুলো বাইবেলে উল্লেখিত চরিত্রগুলোর মতন সীমাবদ্ধ নয় বরং অনাদিকাল ধরে উন্মুক্ত–জেনেসিসের চরিত্রগুলোর মতন অসীম সম্ভাবনাময়।

 

পাদটীকা:

সাহিত্যিক লানা ডেরকাকের জন্ম ১৯৬৯ সালে ক্রোয়েশিয়ার পোজিগা শহরে। কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক ও উপন্যাস–সাহিত্যের এমন সব শাখাতেই তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। ক্রোয়েশিয়া সহ আন্তর্জাতিক নানা দৈনিক পত্রিকা, সাহিত্য পত্রিকা ও সংকলনে তাঁর সাহিত্যকর্ম স্থান করে নিয়েছে। তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম এখন অবধি বিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ইতিমধ্যে তার নিজ দেশ সহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

তারিখ: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫

প্রকাশক: সাবিহা হক, অধ্যাপক, ইংরেজি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

all rights reserved by - Publisher

Site By-iconAstuteHorse