বইয়ের কথা
তাসনিয়া
“তেইশ নম্বর তৈলচিত্র”
লেখক: আলাউদ্দিন আল আজাদ

বসুন্ধরার শ্রেষ্ঠ কাহিনি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত আধুনিক ক্লাসিক উপন্যাস এটি। তেইশ নম্বর তৈলচিত্র বইটি লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ এর প্রথম উপন্যাস। “পদক্ষেপ” নামের একটি অনিয়মিত কাগজের ঈদ সংখ্যায় গল্পটি প্রথম ছাপা হয়েছিল (১৯৬০) । উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে “বসুন্ধরা” নামে। আজ থেকে ছয় দশক আগে লেখা হলেও উপন্যাসটির প্রেক্ষাপটগুলোর সাথে আজকের সময়ের মিল খুঁজে পাবেন অনেকেই। সার্থক উপন্যাসের এটাই গুণ যে পাঠক সহজেই এর সম্বন্ধস্থাপন করতে পারেন সমকালীন সমাজের সাথে।
উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র জাহেদ একজন চিত্রশিল্পী।তার আঁকা “মাদার আর্থ” ছবিটি জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে প্রথম হয়েছিলো। এই ছবিটিকে ঘিরেই লেখক পুরো উপন্যাসটি লিখেছেন। জাহেদের আঁকা ছবিটি যখন গুণী মহলে বহুল প্রশংসিত হয়, তখন জাহেদ তার শিল্প জীবনের এবং ছবির পেছনকার গল্প বলে।
চিত্রশিল্পী মাত্রই মনে করেন ভালোবেসে কারো সাথে জড়িয়ে যাওয়া, কিংবা বিয়ের পর তাঁদের শিল্পী চরিত্রের বিনাশ ঘটে। জাহেদ চরিত্রটি এরই একটি বিপরীত উদাহরণ। এখানে তার ভালোবাসা শিল্পী চরিত্রের বিনাশ নয় বরং এই প্রেমে একে অপরের দোষ- ত্রুটি সবটুকুকে ভালোবেসে তার শিল্প জীবনের প্রেরণার কথা বলে। মানুষ স্বভাবতই সবকিছুতে নিখুঁত কিংবা ত্রুটিহীনতা খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু বাস্তবতা যে নিখুঁত নয় আর আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলো যেমন তাদের তেমনই গ্রহণ করে নিতে হয় তা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারা যায় গল্পে। পাশাপাশি সংসার জীবনে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা তিক্ত সত্যের মোকাবেলা সত্যিকার অনুরাগ দিয়েই করতে হয়- এই বোধটুকু পাঠকদের মাঝে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন ঔপন্যাসিক। বাংলা সাহিত্যে এমন চিত্রশিল্পীর জীবন নিয়ে লেখা খুব একটা উপন্যাস পাওয়া যায় না। জাহেদের স্ত্রী ছবি’ই তার আঁকা পোট্রের্ট ‘মাদার আর্থ’ বা ‘বসুন্ধরা’ ছবিটির জন্মধাত্রী। সেই সাধারণ মেয়ে ছবি যার মধ্যে ছিলো অনিন্দ্য কিছু যা জাহেদ কে প্রকৃত অর্থে শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলো।
পুরো উপন্যাস জুড়েই জাহেদ চরিত্রে মুগ্ধ হতে হয়েছে যে কিনা প্রতি মুহুর্তে তার স্ত্রী ছবিকে আবিষ্কার করতো এক নতুন রূপে। অত্যন্ত সাধারণের মাঝেই অসাধারণ এই চরিত্রটি।ভালোবেসে অবশেষে শরতের একদিনে বিয়ে হয়েছিল জাহেদ-ছবির। বিয়ের পরই সে ছবির দেহে স্পষ্ট মাতৃত্বের মানচিত্র খুঁজে পায়। কিছু অস্বাভাবিকতা মেশানো অসম্ভব রকমের বাচ্চাপ্রীতিও ছিলো ছবির মধ্যে। মুহূর্তেই তার পুরো জগৎ স্পন্দিত হয়ে ওঠে। কোথাও একটা সুর যেন কেটে যায়। প্রিয়তমার প্রতারণা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। দীর্ঘ কয়েকদিন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়ে সে একসময় ছবির কাছে প্রশ্ন করে, “কেন ধোঁকা দিলে?” উত্তরে ছবির কান্নাজড়িত কন্ঠের বর্ণনা জাহেদকে ছবি সম্পর্কে এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
জানতে পারে বিয়ের আগেই ছবির সাথে কোনো এক চরম দুর্ঘটনার শিকার হয়; অন্য এক বিকৃত মানসিকতার। ছবির দাদা জামিলের কাছে যাতায়াত করা এক মানুষরূপী বর্বরের হাতে বাধ্য হয়ে সকলের অজান্তে তার নিরীহ আত্মসমর্পণের গল্প সে বার বার চাইলেও বলতে পারেনা জাহেদকে। সেই দূর্ঘটনায় ছবির গর্ভে আসা বাচ্চাটিকে পরে গর্ভপাত করে নষ্ট করে দেয়া হয়। শিশুর কান্নায় কিভাবে সেই মায়ের বুক হাহাকার করে উঠবে না!
জাহেদ অনুভব করে সেই দুর্ঘটনায় ছবি ছিল নিতান্তই অসহায়, তাই সেই নির্মম সময় আর অতীতকে ভুলে যাওয়াই শ্রেয়।
জাহেদের ভাষায়, “আমি সামান্য আঘাত করলেই এখন সে মুষড়ে পড়বে এবং তাতে আমার মনের ঝাল মিটবে, কিন্তু ঐটুকুই, আর কোনো লাভ নেই। অপরপক্ষে, ইচ্ছে করলেই আমি এখন ওকে আরো মঞ্জরিত করে তুলতে পারি, করতে পারি আরো সার্থক ও সুন্দর। তার জন্য প্রয়োজন প্রেম ও ক্ষমা।”
লেখক জাহেদ চরিত্রে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রতারণা বুঝেও কিভাবে বিশ্বাস করতে হয়, আর এক বুক ঘৃণা চাপা দিয়েও দিব্যি প্রেম করা যায়। ছবি আর তার ভালবাসাই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য।কঠিন আঘাতকেও তো ভুলে যায় মানুষ আর যা বিস্মৃতির যোগ্য তাকে ভুলা কি এমন কঠিন? ভালোবাসাটাই তো বড় সত্য। জাহেদ আবিষ্কার করেছিলো প্রেমের মধ্য দিয়ে যে মাতৃত্ব সেখানেই রয়েছে সত্য ও নারী জীবনের সার্থকতা। জন্মের আগেই ছবির মারা যাওয়া শিশুর ব্যাকুলতায় ছবির মন অস্থির থাকে সবসময়। নতুন যে শিশুটি জন্ম নেবে তাকে কোলে নিয়ে ছবির সেই ছবিটিই হবে মাতৃত্বের গভীর মোহন রূপ।
অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন আসে আর জাহেদ ছবিকে আঁকে যার কোলে বসে আছে ছোটো শিশু টুলটুল। সেই ছবির নামই “বসুন্ধরা”। যেটিই কিনা “তেইশ নম্বর তৈলচিত্র”।
একজন শিল্পীর দৃষ্টিতে জীবনবোধ, তাঁর জীবনের বিচ্যুতি ও প্রেমের তীব্রতা, প্রেম ও প্রাণের প্রকৃত স্বরূপ এবং সত্যকে গ্রহণ করার সক্ষমতাকে তুলে ধরায় আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলা সাহিত্যের এক অনুপম উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’।
ভালো লাগার মত অনেক গুলো লাইন রয়েছে বইটিতে।
যেমনঃ
“জীবন পদার্থ টা আশ্চর্য রকম স্থিতিস্থাপক। যে কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।সে মরে না,কারণ বেঁচে থাকাই তার ধর্ম।”
“নগ্নতায় একটি আদিম পবিত্রতা আছে, কিন্তু নগ্নতা যেখানে সভ্যতারই বিকৃতি সেখানে তার রূপও বিকারগ্রস্ত নয় কি?”
উপন্যাসটি পড়ে আমি অভাবিত স্বাদ পেয়েছি। প্রিয় পাঠকগণ, আপনারাও চাইলে একবার “তেইশ নম্বর তৈলচিত্রের” রঙে রাঙিয়ে নিতে পারেন নিজেকে!
তারিখ: নভেম্বর ৯, ২০২১



AstuteHorse