ভাষা: কি শিখছি, কেনো শিখছি

“Linguistic hybridity is our new identity.”

-Braj B. Kachru

 

একটা মজার ঘটনা দিয়ে এই লেখাটি শুরু করতে চাই। আমি সম্প্রতি জার্মান ভাষা শেখার ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। প্রথম ক্লাসে পরিচয় পর্বে আমি বললাম-

Guten morgen.

Ich haise Rakesh Sikder.

Ser efreut.

শিক্ষিকা যারপরনাই খুশি হয়ে বললেন- বাহ! এই ছেলে তুমি জার্মান শিখলে কোথায়? আমি বললাম- ম্যাডাম, আমি শুধু আজ ক্লাসে আসার আগে ইউটিউব দেখে এই তিনটে phrase শিখে এসেছি। আমার সরল স্বীকারোক্তিতে ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল। কিন্তু আমি একটা জানা জিনিসই নতুন করে শিখলাম। লেখাটি পড়ে শেষ করতে পারলে পাঠকেরাও তা জেনে যাবেন।

‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন আমাদের গর্বের বিষয়। ভাষার নামে আমাদের দেশের নাম। কিন্তু বৈশ্বিক এই পৃথিবীতে আজকের দিনে শুধু মাতৃভাষা শিখেই থেমে আছে এমন শিক্ষিত লোকজন খুবই কম আছে বলে মনে করি। কোনো না কোনো কারনে আমাদের নতুন একটি ভাষা শিখতে হচ্ছেই। হোক তা শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে বা কর্মজীবনের সুবিধার্থে। দ্বিতীয় ভাষা শেখার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম Duolingo এর বরাতে জানা যাচ্ছে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক। তার পরপরই তালিকায় উঠে আসছে এসপানোল ভাষার নাম।

দেশ-বিদেশ তূলনামূলক  নতুন ধারনা (concept)। প্রত্ত্বতাত্তিক প্রমাণসমূহ জানান দিচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভূ-খন্ডে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার উপস্থিতির কথা। পরবর্তীকালে, সেসব সভ্যতার শিলালিপি উদ্ধার করা সাপেক্ষে জানা গেছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার কথা, লিপির (alphabet) কথা। আর জ্ঞানের dispersion যেমন এখনও হয়ে থাকে, তেমন তখনও যে হয়েছিল তারই প্রমাণ এসব ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মিলগুলো।

আজ আমরা ভাষা বলতে যা বুঝি তার গোড়াপত্তন যদি ধরে নিই Hunter-gatherer সমাজব্যবস্থা থেকেই, তার পরেও কেটে গেছে কম করে হলেও প্রায় কয়েক হাজার বছর। আর এই সময়ে পরিবর্তন এসেছে ভাষাতেও। আজ যে ইংরেজি কে আমরা বিশ্বব্যাপী prestige language হিসেবে ধরে নিচ্ছি, সেই খোদ ইংরেজদের কাছেই কিন্তু এই কয়েকশ’ বছর আগেও prestige language ছিল ফরাসি ভাষা। ভুলে গেলে চলবে না, এই পরিবর্তনটা কোনো এক জনের একার প্রয়াস নয়। পুরো একটা জাতির দ্বারা আমরা কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবিত হয়েই তাদের ভাষাকে আত্মস্থ করেছি। তবুও মাতৃভাষায়ই লিখতে যে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি তার প্রমাণ ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হয়েও জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রমুখের বাংলা সাহিত্যে অবদান।

আমার মাতৃভাষা বাংলা। উচ্চশিক্ষার জন্য পড়ছি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। কিছুদিন আগে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাসে নাম লিখিয়েছি। উচ্চাংগ সংগীত যা শুনি তার সাহিত্য কন্নড়, সংস্কৃত, তেলুগু, হিন্দি, তামিল, মারাঠী ইত্যাদি ভাষায়। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে কি চাই-ইশারা ভাষা শেখার জন্যে Sign Language For Dummies বই টি সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করেছিলাম। এখন নব্য সভ্য hypocrite-রা আমাকে যদি “বিদেশী সংষ্কৃতির আগ্রাসনের শিকার” আখ্যা দিতে চান তাহলে কোনো একটা দেশের নাম আলাদা করে বলতে গেলে তাদের সমস্যায়ই পড়তে হবে। আমি নিজেও বাংলায় লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এই কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সাময়িকী ‘পিলসুজে’ আমার লেখা ‘অনিকেত প্রান্তর’ নামের একটি গল্প বেরিয়েছে এবং বন্ধুমহলে-সিনিয়রদের কাছে অনেক সমালোচনা ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আমার তাতে ভালই লেগেছে। ইংরেজিতে লিখলে লেখাটা এত পাঠক নাও পেতে পারত।

সব কিছুর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে। স্বভাবতই আপনি অচেনা শহরে হাজার লোকের ভীড়ে নিজের ভাষা শুনলে ফিরে তাকাবেন। এ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমার মনে আছে, দুবাইর এক শপিং মলে আমরা পরিবারের লোকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। আমাদের মুখে বাংলা শুনে এক অপরিচিত বাঙালি মহিলা পাশের আইল(aisle)  থেকে এসে নিজে যেচে আলাপ করে গেলেন। সেবারই নতুন বছরের আতশবাজি দেখতে আমরা গেছি জুমেরা বিচ রেসিডেন্সে(JBR)। আশে পাশে এত এত ethnicity এর মানুষ। কেউ কাউকে জায়গা দেবে না। আমি ব্রিজের উপর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আরব সাগরের মাঝে বোট থেকে ছোড়া রং-বেরং এর আতশবাজি দেখছি। এমন সময়ে বাংলা শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি এক কলকাতার দম্পতি তাদের ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ভীড়ের মাঝে হিমশিম খাচ্ছেন, তাদেরকে নিজের premium জায়গা ছেড়ে দিতে আমার একটুও বাধে তো নি বরং যেনো আনন্দই হচ্ছিলো।

তো কেনো শিখবেন নতুন একটা ভাষা? পৃথিবীটা এখন অনেক বেশিই বৈশ্বিক। ভিনদেশী একটা বন্ধু বানানোর জন্য, দেশের বাইরে ফ্লাইটের লাইনে একটুখানি এগিয়ে থাকার জন্য, ক্যারিয়ারে আরেকটু এগিয়ে যাবার জন্য, নিজের ভালো লাগার জন্য, বন্ধুর সাজেস্ট করা কোরিয়ান মুভিটা হয়ত সাবটাইটেল ছাড়াই দেখতে পারার জন্য। তাছাড়া শুধু ইংরেজি না, আরো কয়েকটা ভাষার অল্প কিছু সাধারন বিষয় জেনে রাখলেন। কোনো দিন তো কাজে লেগে যেতেও পারে!

তারিখ: নভেম্বর ৯, ২০২১

প্রকাশক: সাবিহা হক, অধ্যাপক, ইংরেজি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

all rights reserved by - Publisher

Site By-iconAstuteHorse