সন্তুষ্টির সন্ধানে
Sparkaneers
(এডওয়ার্ড আলবি’র দি অ্যামেরিকান ড্রিম অবলম্বনে)
রূপান্তরে:
সানজিদা আফরোজ, প্রান্ত সরকার, তাহ্রিমা হোসেন, শোভন দাস, সাদিয়া ইসলাম,
মোঃ আজিবর রহমান আবির, নিশাত তাসনিম, আহসানুল হক, সাদিয়া সিদ্দিকা
ভূমিকা
এডওয়ার্ড আলবি`র দি অ্যামেরিকান ড্রিম আমেরিকার প্রেক্ষাপটে রচিত এক অনবদ্য সাহিত্যকর্ম যা আমেরিকাবাসীদের চিরদিনের লালিত স্বপ্ন ও সেই স্বপ্নের নিরিখে তাঁদের পথচলা প্রতীকরূপে তুলে ধরে। ‘অ্যামেরিকান ড্রিম’ মানুষের এক চিরন্তন স্বপ্ন। এই স্বপ্নের পথেই মানুষের চির পথ চলা। তাই আমরা এই স্বপ্নকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান সমাজকে চিত্রিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে নাটকটি পুনরায় তৈরি করেছি। এর সুবিধার্থে আমরা নতুন কয়েকটি চরিত্রও নির্মাণ করেছি। আশা করি, একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বর্তমান সমাজকে চিত্রিত করে পরিবর্তিত এ নাটকটি পাঠকদের মনে এ দেশের মানুষের চিরায়িত স্বপ্ন ও তার নিরিখে যাপিত জীবনযাত্রাকে কিছুটা হলেও তুলে ধরতে সক্ষম হবে।
মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও নাটকটির এ নতুন রূপে যে ভুল এবং ত্রুটিবিচ্যুতি রয়ে গেল সে জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
চরিত্রসূচি
বাবুর আম্মু
বাবুর আব্বু
দাদিমা
মিসেস চৌধুরী
যুবক
হকার
আক্কাস
বুয়া
ধানমন্ডির একটি দুই কক্ষ বিশিষ্ট ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুম। পাশাপাশি দুটি চেয়ার তির্যকভাবে বসানো। পেছনের দেয়ালের বিপরীত দিকে একটি সোফা। একটি দরজা, যেটি স্টেজের বাম পাশে, ফ্লাটের বাইরে যাওয়ার জন্য। স্টেজের ডান দিকে ড্রয়িং রুমের বাইরে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তা। শুরুতেই বাবুর আব্বু ও বাবুর আম্মুকে চেয়ার দুটিতে বসে কথা বলতে দেখা যাবে।
[পর্দা উঠবে। কিছুক্ষণ নীরবতা। অতঃপর…]
বাবুর আম্মু : উহ! বুঝিনা, তারা কেন এত দেরি করছে!
বাবুর আব্বু : (বিরক্তি ভাব) ওরাতো সব সময়ই দেরি করে।
বাবুর আম্মু : কোন সময়ে করে না! যত্তসব!
বাবুর আব্বু : সবকিছু এখন এভাবেই চলছে। কিছু করারও নেই আমাদের।
বাবুর আম্মু : হুম, ঠিকই বলেছ।
বাবুর আব্বু : যখন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম, অঙ্গীকার নামায় সই নিতে তো দেরি করেনি। আবার
অগ্রিম ভাড়া নিতেও কিন্তু দেরি করেনি…
বাবুর আম্মু : সাথে একমাসের জামানতও।
বাবুর আব্বু : (উদাসীন ভাবে) হ্যাঁ, সাথে একমাসের জামানতও। তারা আমাদের খোঁজখবর নিতেও
দেরি করেনি। তখন তারা কোন কিছুতেই দেরি করেনি। কিন্তু এখন দেখো! ফ্রিজ সারাতে যাও, কলিং বেল সারাতে যাও, ওয়াশরুম সারাতে যাও…যাই দরকার হোকনা কেন, কোনকিছুই তারা সময়মতো করে না।
বাবুর আম্মু : ঠিকই বলেছ, কোন কিছুই তারা সময়মতো করে দেয়না। এখন মানুষ মনে করে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। করেও। গতকাল আমি একটা ব্যাগ কিনতে গিয়েছিলাম। (একটু থেমে বাবুর দিকে তাকিয়ে) শোনো কি বলছি। গতকাল আমি একটা ব্যাগ কিনতে গিয়েছিলাম।
বাবুর আব্বু : ওহ, তাই নাকি? তারপর?
বাবুর আম্মু : (একটু জোর দিয়ে) কথা শোনো।
বাবুর আব্বু : শুনছি তো।
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, শুনলেই ভালো।
বাবুর আব্বু : শুনছি তো।
বাবুর আম্মু : (ব্যাগের বিষয়টা চিন্তা করে একটু হেসে) ঠিক আছে তাহলে। আমি কাল দোকানে গিয়ে ব্যাগ দেখতে চাইলে তারা আমাকে কিছু সবুজ আর কিছু নীল ব্যাগ দেখালো… আমার সেগুলার কোনটাই পছন্দ হচ্ছিলো না। (বাবুর আব্বুকে উদ্দেশ্য করে) কী বললাম আমি? এইমাত্র আমি কী বললাম?
বাবুর আব্বু : কোনটাই তোমার পছন্দ হচ্ছিলো না।
বাবুর আম্মু : আচ্ছা, শুনছো তাহলে। তারপর তারা সুন্দর একটা ব্যাগ দেখালো, যেটা আমার পছন্দ হলো। আমি বললাম, “বাহ! এই ব্যাগটা তো খুব সুন্দর! আমি এটাই নেবো। এটা কি রং?” ওরা বললো, “কেন, এটি ঘিয়ে রং!“ আমি বললাম, ”যাইহোক না কেন, ব্যাগটা কিন্তু বেশ!” তারপর আমি ওই ব্যাগটাই কিনলাম। (বাবুর আব্বুর দিকে তাকিয়ে)
বাবুর আব্বু : (মনোযোগের সাথে তাকিয়ে) তাহলে তুমি ওটাই কিনলে?
বাবুর আম্মু : ব্যাগটা নিয়ে আমি দোকান থেকে বের হতে না হতেই দেখি “ধানমন্ডি উইমেন্স ক্লাব” এর চেয়ারম্যান। তিনি আমার ব্যাগটা দেখে বললেন, ”বাহ! তোমার ব্যাগটা তো খুব সুন্দর! এই অফ-হোয়াইট রঙের ব্যাগগুলো আমার খুব পছন্দের।” আমি বললাম, ”না, এটা তো ঘিয়ে রং।” তিনি বললেন, ”না, না। এটা তুমি কি বলছো? এটা তো অফ-হোয়াইট। আমি অফ-হোয়াইট আর ঘিয়ে রঙের পার্থক্য বুঝি।” আমি বললাম, ”হ্যাঁ, আমিও তো বুঝি।” কী বললাম আমি? এইমাত্র আমি কী বললাম?
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, এটাতো আমিও বুঝি!
বাবুর আম্মু : ঠিক আছে। তারপর তিনি হেসে বললেন, ”এটা অবশ্যই অফ হোয়াইট…যদি আমি কখনো অফ-হোয়াইট দেখে থাকি! যাইহোক, ব্যাগটা সুন্দর!” তারপর তিনি চলে গেলেন। তুমি জানো না, সে কী ভয়ংকর মহিলা! কী অদ্ভুত তার রুচি! বাচ্চা দুটোও অদ্ভুত! বাড়িটাও অদ্ভুত! তবে তার স্বামীটা ভালো। সে সবসময় হুইল চেয়ারে বসে থাকে। তিনি সত্যিই ভয়ংকর এক মহিলা। তবুও তাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি যেহেতু তিনি ক্লাবের চেয়ারম্যান। যাইহোক, তারপর আমি আবার দোকানে ফিরে গেলাম। দোকানের লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, ”আপনারা কেন ঘিয়ে বলে আমাকে অফ-হোয়াইট রঙের ব্যাগ দিলেন? আমাকে বোকা বানানো অত সহজ নয়! আপনাদের এই আর্টিফিশিয়াল লাইটের জন্যই আমি প্রথমে রঙটি বুঝতে পারিনি।” তাদের দোকানে আর্টিফিশিয়াল লাইট ছিলো, জানো?
বাবুর আব্বু : তাই!
বাবুর আম্মু : তারপর আমি তাদের ব্যাগটা চেঞ্জ করে দিতে বললাম। তারা বললো, “বিক্রিত মাল ফেরৎ হয় না।” তাদের কথায় আমি রেগে গিয়ে ব্যাগটি কাউন্টারে ছুঁড়ে মেরে উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করতে থাকি…
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালোই করেছো!
বাবুর আম্মু : কী এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো! তখন তারা ঘাবড়ে গিয়ে আগের ব্যাগটা ফেরত নিয়ে একইরকম আরেকটা ব্যাগ এনে দেখালো। আমি একনজর দেখেই বললাম, ”এটা তো ঘিয়ে নয়, অফ- হোয়াইট।” তারা বললো, ”না, ম্যাডাম, এটা ঘিয়ে। আপনি চাইলে বাইরে গিয়ে দেখতে পারেন।” বাইরে নিয়ে আমি ব্যাগটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। ওটা ঘিয়ে রঙই ছিলো। তাই ওটাই নিয়ে নিলাম।
বাবুর আব্বু : আমার মনে হয় এটা সেই ব্যাগটাই যেটা ওরা তোমার কাছে আগে বিক্রীর চেষ্টা করেছিলো।
বাবুর আম্মু : (মুচকি হেঁসে) হ্যাঁ, ওটাইতো ছিল!
বাবুর আব্বু : সবকিছু এখন এভাবেই চলছে। আজকাল কোন কিছুতেই সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না। আমরা কেবল চেষ্টা করে যাই।
বাবুর আম্মু : আমি কিন্তু সন্তুষ্ট হয়েছিলাম।
বাবুর আব্বু : ঠিক বলেছ, তুমিতো সন্তুষ্ট হয়েছিলে।
বাবুর আম্মু : উফ! বুঝিনা, তারা কেন এত দেরি করছে!
বাবুর আব্বু : এই ওয়াশরুমটা ঠিক করানোর জন্য দুই সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করছি।
বাবুর আম্মু : তুমি শুধু চেষ্টাই করতে পারবে, সন্তুষ্টি পাবে না। আমি কিন্তু সন্তুষ্টি পেতে পারি, কিন্তু তুমি পাবে না।
বাবুর আব্বু : আমি কিন্তু আমার জন্য চেষ্টা করছি না। আমি তো যখন তখন ক্লাবেই যেতে পারি।
বাবুর আম্মু : এটা কিন্তু আমারও অতটা প্রয়োজন নয়। আমিও তো শপিং এ যেতে পারি।
বাবুর আব্বু : সত্যি বলতে, এটা দাদিমার জন্যই।
বাবুর আম্মু : অবশ্যই এটা দাদিমার জন্য। সে এমনিতেই ওয়াশরুমে যাওয়া নিয়ে চেঁচামেচি করে, আর এখন তো তা আরও বেড়ে গেছে। দাদিমা মনে করে, ওয়াশরুমের সমস্যা তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দিচ্ছে।
বাবুর আব্বু : আসলেই দাদিমা দিনদিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
বাবুর আম্মু : অবশ্যই দাদিমা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এটা ওয়াশরুমের জন্য নয়।
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, এটা সত্যি। যাই হোক, ওয়াশরুমটা আমাদের ঠিক করাতেই হবে।
বাবুর আম্মু : উফ! তারা যে এত দেরি করতে পারে!
বাবুর আব্বু : প্রথম প্রথম তো তারা ডাকার আগেই চলে আসতো। আর এখন দেখো! কোন খোঁজ নেই।
[সুন্দর ভাবে র্যাপিং করা কিছু বক্স নিয়ে দাদিমার প্রবেশ]
বাবুর আম্মু : দাদিমা, তুমি এসব কি নিয়ে এসেছো?
দাদিমা : এগুলো তো বাক্স। কেন, তোমার কি অন্য কিছু মনে হচ্ছে?
বাবুর আম্মু : দেখো, বাবুর আব্বু, দাদিমা কিসব নিয়ে এসেছে!
বাবুর আব্বু : ও মা! কত গুলো বক্স!
দাদিমা : আমি এগুলো কোথায় রাখবো?
বাবুর আম্মু : আমি তার কী জানি? কী করবে তুমি এগুলো দিয়ে?
দাদিমা : সেটা কারোর না ভাবলেও চলবে!
বাবুর আম্মু : আচ্ছা, বেশ। বাবুর আব্বুর পাশে…ঐ ওখানে রাখো।
দাদিমা : (বক্সগুলো বাবুর আব্বুর পায়ের কাছে রেখে) আশা করি তুমি ওয়াশরুমটা এবার ঠিক করাবে।
বাবুর আব্বু : আমিও তো চাই তারা দ্রুত ওয়াশরুমটা ঠিক করে দিক। কিন্তু আপনি যে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছেন…
বাবুর আম্মু : দাদিমাকে এসব কী বলছো তুমি?
দাদিমা : তুমি আমাকে এভাবে বললে!
বাবুর আব্বু : আমি সর্যি, দাদিমা।
বাবুর আম্মু : বাবুর আব্বু সর্যি, দাদিমা।
দাদিমা : বেশ, আমাকে এখন বাকি বাক্সগুলো আনতে হবে। বৃদ্ধ হয়েছি তো… এমন ব্যবহারই হয়তো আমার প্রাপ্য! মানুষ মনে করে, যখনি তুমি বৃদ্ধ হবে, তোমাকে হয় মৃত্যুকে গ্রহণ করতে হবে না হয় তোমাকে জগৎ সংসারের বিভীষিকায় জ্বলতে হবে। কিন্তু আসলে যা হয় তা হলো, সবাই তোমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করবে।
বাবুর আব্বু : (অনুতপ্ত হয়ে) দাদিমা, আমি সত্যিই সর্যি।
বাবুর আম্মু : দাদিমা, বাবুর আব্বু সর্যি বলেছে তো!
দাদিমা : হ্যাঁ, সর্যিই তো সব কিছু! মানুষ সরি বলবে… এতে তোমার আত্মসম্মানবোধ বাড়বে! এটাই তো সবকিছু…আত্মসম্মানবোধ! এই আত্মসম্মানবোধই তো সভ্যতাটাকে টিকিয়ে রেখেছে!
বাবুর আম্মু : এটা আমার ওই বইয়ের কথা না? তুমি আবার আমার বইয়ে হাত দিয়েছো?
বাবুর আব্বু : বাব্বুর আম্মুর বইয়ে হাত দেওয়ার সাহস হয় কিভাবে আপনার!
দাদিমা : কারণ, আমার বয়স হয়েছে। বৃদ্ধদেরও তো কিছু না কিছু করতে হয়। কিন্তু যখন তারা কারও সাথে কথা বলতে যায়, তখন অবহেলাই কপালে জোটে। এ থেকে বাঁচতে হলে, হয় তোমাকে হয় বধির হতে হবে, নাহয় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে হবে। আর এভাবেই এক সময় তাদের মৃত্যু হয়।
হকার : (নেপথ্যে) আলু পাঁচ কেজি একশো… পেঁয়াজ তিন কেজি একশো…রসুন দুই কেজি একশো…সবজি নেন… টাটকা সবজি… অনেক পদের সবজি…
বাবুর আম্মু : ঘরে মাত্র চার দিনের বাজার আছে। সবজি ওয়ালা এসেছে। যাও তো, সবজি নিয়ে এসো।
বাবুর আব্বু : দেশের মানুষ না খেয়ে মরছে আর তুমি চার দিনের বাজার থাকতেও বলছো বাজার আনতে!
বাবুর আম্মু : অত লোকের চিন্তা করতে হবেনা। যা বললাম তাই করো। এহ, দেশের লোকের জন্য কী দরদ!
বাবুর আব্বু : আচ্ছা যাচ্ছি। ব্যাগটা দাও।
বাবুর আম্মু : রান্নাঘরে আছে। ওখান থেকে নিয়ে যাও।
[বাবুর আব্বুর প্রস্থান]
দাদিমা : এখনকার পুরুষেরা বউয়ের কথায় ওঠে আর বসে! আমাদের সময়ে কী ছিল আর এখন কী হয়েছে! আমি যাই, বাকি বাক্সগুলো নিয়ে আসি…
[দাদিমার প্রস্থান]
[স্টেজে হকারকে দেখা যাবে]
হকার: আহেন আহেন সার। টাটকা সবজি। একদম ফেরেশ।
বাবুর আব্বু : সবজিতো টাটকা মনে হচ্ছে না। সবই তো মনে হয় বাসি, শুধু পানি ছিটিয়ে ফ্রেশ বললে হবে!
হকার : কি যে কন সার। মাত্রই টেরাক থ্যাইকা নামাইয়া আনছি ( আমতা আমতা করে) বাগান থ্যাইকা তুইলা আনছি।
বাবুর আব্বু : তাই নাকি। টমেটো কত করে? রসুন কত?
হকার : টমেটো ৪০, আলু ২০, রসুন ১০০ টাহা।
বাবুর আব্বু : দাম তো অনেক বেশি মনে হচ্ছে।
হকার : আমাগো হাথে কিছু নাই সাব। বাজার অহন গরম, জানেনই তো। সবই উপরতলার মাইনষের হাথে। আমরা হুধু নীরব দর্শক।
বাবুর আব্বু : দেশের যে অবস্থা! সব জিনিসের দাম বেশি অথচ চাষীরা দাম পায় না। থাক সেসব কথা। তুমি ভালো দেখে ১ কেজি আলু, ১ কেজি টমেটো আর আধা কেজি রসুন দাও।
হকার : এই লন সাব। ১৫০ হইছে। আপনার জন্যে ১৩০ টাহা।
বাবুর আব্বু : (বাবুর আব্বু টাকা দিতে যাবে, সয়াবিন তেলের বোতল দেখবে) সয়াবিন তেলও আছে দেখছি তোমার কাছে।
হকার : হ সাব, এই সময় ত্যাল না ব্যাঁচলে কি হয়! অহন তো সব জায়গাতেই ত্যাল সাব। তাই ঠিক করলাম, আমিও পানির দামে পানি…ত্যাল বেচি।
বাবুর আব্বু : কত তোমার সেই তেলের দাম শুনি!
হকার : সবাই ব্যাঁচে ১৬০ টাহায়। আমি সাত্তার। আমার কাছে পাইবেন মাতরো ১৩০ এ।
বাবুর আব্বু : ১ লিটার সয়াবিন তেলসহ মোট কত হলো?
হকার : ২৮০ হয়। ২৪০ টাহাই দ্যান।
বাবুর আব্বু : অত বেশি দাম হয় নাকি। ৩০০ দিচ্ছি ৫০ টাকা ফেরত দাও।
হকার : আইচ্ছা। (বাবুর আব্বুর দিকে আড়চোখে তাকাবে। টাকা ফেরত দিবে।)
[বাবুর আব্বু চলে যেতে থাকবে]
বাবুর আব্বুঃ বাহ! জিনিসগুলো কিনে বেশ লাভই হল।
হকার : ব্যাটা বেকুব। সয়াবিন আর পাম ত্যালের পাইর্থক্যও ধরবার পারে না। (হকার উপরের দিকে তাকিয়ে) ও খোদা, আমার কোনো দোষ নাই। আমিতো ত্যাল কইছি। পাম নাকি সয়াবিন মুহেও আনি নাই।
[স্টেজে বাবুর আব্বু ও বাবুর আম্মুকে দেখা যাবে]
বাবুর আব্বু : জিনিসপত্রের এত দাম!
বাবুর আম্মুঃ কি এনেছো দেখি।
বাবুর আব্বু : কি আর আনবো। জিনিসপত্রের এত দাম… আচ্ছা, দাদিমাকে তো দেখছি না। উনি কোথায় গেলেন?
বাবুর আম্মু : বাকি বক্সগুলো আনতে গেছেন। দাদিমা মনে হয় একটু কষ্ট পেয়েছেন।
বাবুর আব্বু : বেচারা দাদিমা। আমি ওনাকে আঘাত করতে চাই নি। উনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।
বাবুর আম্মু : এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সে কিছুই মনে রাখবে না। দাদিমা কি বলে, সে নিজেই জানে না।
বাবুর আব্বু : না, সে জানে সে কি বলে।
বাবুর আম্মু : এসব নিয়ে ভেবো না তো। আমি ভালবাসি দাদিমাকে।
বাবুর আব্বু : আমিও তাকে ভালবাসি। দেখ, কত সুন্দর করে দাদিমা বক্সগুলো র্যাপিং করেছেন।
বাবুর আম্মু : দাদিমা সবসময়ই সুন্দর করে র্যাপিং করে। দাদা বেঁচে ছিলেন না বলে আমার ছোটবেলায় আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিলনা। আমি স্কুলে যাওয়ার সময় প্রতিদিন দাদিমা আমার টিফিন র্যাপিংকরে দিতো। দুপুরে খাবার সময় আমার বন্ধুরা তাদের বক্স থেকে চিকেন, কেক, এগুলো বের করে খেতো। কিন্তু ওদের বক্সগুলো তেমনভাবে র্যাপিং করা থাকতো না। আর আমার বক্স দাদিমা এত সুন্দর করে র্যাপিং করে দিতো যে সেটা আমার খুলতেই ইচ্ছে করতো না।
বাবুর আব্বু : কারণ সেটা খালি থাকতো!
বাবুর আম্মু : না, না খালি থাকতো না। প্রতিদিন দাদিমা তার রাতের খাবার বাঁচিয়ে রেখে সেটা আমাকে টিফিনে দিতো। আমি সেগুলো না খেয়ে ফেরত এনে দাদিমাকে দিতাম আর দাদিমা সেটা খুলে খেতো। দাদিমা বলতো, “আমি বাসি খাবার খেতে পছন্দ করি।“ সেই থেকেই আমি বাসি খাবার শব্দটার সাথে পরিচিত। দাদিমা সব সময়ে বাসি খাবার খেতো। আমি আমার বন্ধুদের খাবার দিয়েই লাঞ্চ সেরে ফেলতাম। তারা মনে করতো আমার বক্সে কিছুই নেই তাই আমি বক্সটা খুলছি না। আর তাই তারা আমাকে তাদের খাবার দিতো।
বাবুর আব্বু : তুমি তো বেশ চালাক ছিলে!
বাবুর আম্মু : তখন আমরা বেশ গরীব ছিলাম। এরপর আমি তোমাকে বিয়ে করি আর এখন আমরা ধনী।
বাবুর আব্বু : কিন্তু দাদিমা ধনী নয়।
বাবুর আম্মু : হয়তো ধনী নয়। কিন্তু তুমি দাদিমাকে এত ভালো রেখেছো যে সে নিজেকে ধনীই মনে করে। সে অবশ্য জানে না, তুমি তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চাও।
বাবুর আব্বু : কই না তো। আমি তো চাই না।
বাবুর আম্মু : তুমি চাও না, তবে আমি তো চাই। এ বাসায় তাকে রান্না-বান্না, ঘর গোছানোর কাজ করতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।
বাবুর আব্বু : কিন্তু উনি তো এগুলো করতে পছন্দ করেন। উনি হয়তো ভাবেন, এই বাড়িতে থাকতে হলে তাকে কিছু না কিছু করতেই হবে।
বাবুর আম্মু : ঠিকই ভাবে সে। আমি না হয় তোমার উপর নির্ভর করতে পারি, কারণ আমি তোমার বৌ। সে কিভাবে তোমার উপর নির্ভর করবে? তুমি তো ভাগ্যবান, আমি আমার সাথে শুধুমাত্র দাদিমাকে এনেছি। অনেকে তো তাদের পুরো পরিবারকেই নিয়ে আসে। অবশ্য…দাদিমাই আমার পুরো পরিবার!
বাবুর আব্বু : আমি সত্যিই ভাগ্যবান!
বাবুর আম্মু : কেনই বা হবে না…আমার মতো এমন একজনকে পেয়েছো! …যেহেতু তোমাকে বিয়ে করেছি…তোমার সবকিছুতেই আমার অধিকার রয়েছে। আর তুমি যখন থাকবে না, তখন তোমার সব সম্পত্তিতো আমারই! তখন আমি আর দাদিমা একসাথে থাকতে পারবো…যদি না তুমি তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসো।
বাবুর আব্বু : তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।
বাবুর আম্মু : কেউ যদি তার জন্য কিছু করতো!
বাবুর আব্বু : আমি তোমাদের জন্য যথেষ্টই করছি।
বাবুর আম্মু : তুমি তো অনেক ভালো!
বাবুর আব্বু : (তাচ্ছিল্যের সুরে) ঠিক, তোমারই মতো।
[দ্রুত গতিতে বুয়ার প্রবেশ]
বুয়া : আফা…আফা, রান্নাঘরে তো নুন ফুরায় গ্যাছে।
বাবুর আম্মু : কী? লবণ নেই? বাবুর আব্বু, তোমাকে লবণ আনতে বলেছিলাম না?
বাবুর আব্বু : না। লবণ আনতে বলোনি। যাযা বলেছিলে আমি তো নিয়ে এসেছি।
বাবুর আম্মু : সব কি আমাকে বলে দিতে হবে? তুমি কি জানো না রান্নায় কী কী লাগে?
বাবুর আব্বু : তাহলে আবার যেয়ে লবণ নিয়ে আসতে হবে।
বাবুর আম্মু : বুয়া, আমার জন্য হাল্কা কিছু নাস্তা বানিয়ে আনোতো…
বুয়া : আফা যে কি কন? লবণ ছাড়া রান্না করমু ক্যামনে?
বাবুর আম্মু : রান্না করতে কে বলেছে তোমাকে? যাও নাস্তা নিয়ে এসো…
বুয়া : ঐ নাস্তা রান্না একই জিনিস…
বাবুর আম্মু : উফ…তর্ক করো নাতো, যা বলছি তাই শোনো…
বুয়া : যাই বলেন আফা…নুন ছাড়া কিন্তু আমি রান্না ঘরে যাইতাম না…
বাবুর আম্মু : তোমার এতো বড় সাহস, আমার মুখে মুখে কথা বলছো?
বুয়া : মুখে মুখে কথা কইতে যামু ক্যান? আমি আমার মত কতা কইতাছি, আপনার মুখ সামনে আইলে আমি কি করুম…
বাবুর আম্মু : আজকাল দেখি বেশ কথা শিখেছো! ইদানিং তো কাজেও ফাকি দিচ্ছো…
বুয়া : এর থাইক্যা আর ভালো কাজ পারুম না…পারলে নতুন কাউরে খুইজ্যা লন।
বাবুর আম্মু : নতুন কাউকে পেলে কি আর তোমাকে রাখতাম! কবেই বিদায় করে দিতাম…
বুয়া : থাক থাক, আপনের আর বিদায় করন লাগবো না, আমিই আর কাজ করুম না আপনাগো বাসায়।
বাবুর আম্মু : যাও যাও…তোমার কাজ করার জন্য আমাদের দাদিমা আছে।
[বুয়ার প্রস্থান]
[আরও বক্স নিয়ে দাদিমার প্রবেশ]
দাদিমা : যাক, সব বাক্স আনা শেষ।
বাবুর আব্বু : ওগুলো তো খুব সুন্দর করে র্যাপিং করা, দাদিমা।
দাদিমা : অ্যাহ! এসব বলে তুমি আমাকে ভোলাতে পারবেনা।
বাবুর আম্মু : দাদিমা!
দাদিমা : তুমি তো প্রশংসা করেছিলে, কত সুন্দর র্যাপিং করি আমি। আবার তুমিই বলেছ, আমি শুধু ঘ্যানঘ্যান করি।
বাবুর আম্মু : দাদিমা!
দাদিমা : (বাবুর আম্মুকে) তুমি চুপ করো ! অনেক বলেছো।
(বাবুর আব্বুকে) তোমার সমস্যা হলো তোমার কোনো অনুভূতি নেই। বৃদ্ধরা অনেক ধরনের শব্দই করে। বাধ্য হয়েই করে। ঢেঁকুর তোলে, মাঝরাতে চিৎকার চেঁচামেচি করে। তোমরা কি বুঝবে? বৃদ্ধরা ঘুমাতে চায়, কিন্তু পারে না। আর একবার ঘুমিয়ে গেলে আর ওঠে না।
বাবুর আব্বু : আমি দুঃখিত, দাদিমা।
বাবুর আম্মু : থামবে তুমি দাদিমা!
দাদিমা : তুমি থামো, বেয়াদব মেয়ে।
বাবুর আব্বুঃ আমি সত্যিই দুঃখিত দাদিমা।
দাদিমা : আমিতো জানি, তুমি অনেক ভাল। নাটের গুরু হল এই বাবুর আম্মু। তখন আমার কথা শুনলে তুমি এই মেয়ের খপ্পরে পরতে না। সে একটা বেয়াদব মেয়ে ছিল, আছে, থাকবে। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতো। ৩-৪ টা প্রেমও করেছে। এখনো সে বিন্দুমাত্র ভাল হয় নি।
বাবুর আম্মু : আর একটা কথাও বলবে না, দাদিমা! খবরদার।
দাদিমা : (বাবুর আম্মুকে) তুমি চুপ কর! (বাবুর আব্বুকে) জানো তুমি, ছোটবেলা থেকে ও স্বপ্ন দেখতো, যেকোনো মূল্যে কোনো ধনী বয়স্ক লোককে বিয়ে করে বড়লোক হওয়ার।
[নেপথ্যে শব্দ ভেসে আসবে- জীবনে সন্তুষ্টিই আসল বিষয়। এজন্য দরকার টাকা, অনেক টাকা… সন্তুষ্টি]
(বাবুর আব্বুকে) আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, এই মেয়ের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতে। (কথার খেই হারিয়ে ফেলবে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলবে) হ্যাঁ…বলেছিলামই তো তোমাকে।
বাবুর আম্মু : থামো তুমি! ভুলে যেও না, তুমি ওর না, আমার মা।
দাদিমা : আমি তোমার মা?
[রাগে বাবুর আম্মু স্টেজ ত্যাগ করবে]
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, দাদিমা। বাবুর আম্মু তো ঠিকই বলেছে।
দাদিমা : ওহ তাই! বুড়ো বয়সে এসব কি মনে রাখা যায়! (হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলবে) বাবুর আম্মুর চোখ শুধু তোমার টাকার দিকে। দেখো গিয়ে, তোমার টাকা সরাচ্ছে কিনা!
বাবুর আব্বু : (অন্যমনস্ক। হঠাৎ অবাক হয়ে) আচ্ছা দাদিমা! দেখছি আমি।
[বাবুর আব্বুর প্রস্থান]
[দাদিমা সামনে এগিয়ে যেয়ে বলবে]
দাদিমা : সবাই ছুটে চলে সন্তুষ্টির দিকে। সন্তুষ্টি পেতে ন্যায়-অন্যায় বোধ ভুলে যেকোনো কিছু
করতে প্রস্তুত তারা। তবুও কোনো কিছুতেই তৃপ্তি মেলে না।
[মৃদু শব্দে গান বাজবে ‘যা পেয়েছি আমি তা চাইনা’]
[স্টেজে ৪-৫ টা বক্স থাকবে। বুয়ার হাতে ঝাড়ু। গুনগুন করে গান গেয়ে স্টেজে ঢুকবে। দাদিমাও পেছনে পেছনে লাঠিতে ভর দিয়ে আসবেন। বুয়ার গান শুনে তিনিও মাথা দোলাবেন। কিন্তু বুয়া দাদিমার উপস্থিতি টের পাবে না। ঝাড়ু দেয়ার সময় বাক্সগুলো সামনে পড়বে। সে বক্সগুলো সরাতে যাবে। দাদিমা চিৎকার করে তাঁর লাঠি দিয়ে বুয়াকে আলতো গুঁতো দিবেন]
দাদিমা : খবরদার! আমার বাক্সগুলো ধরার সাহস তোমার কি করে হলো? বুড়ো মানুষ
বলে কি আমার কোনো প্রাইভেসি নেই?
বুয়া : প্রাই… ভো… রাইসি! কি কন আম্নে এগুলা। আর এইগুলা যেমনে রাখছেন, কি আর কমু।
আমি তো আইছিলাম এগুলা এট্টু এস্টোররুমে রাইখ্যা আইতে।
দাদিমা: (রাগত স্বরে) কি? (চেয়ারে বসতে গিয়ে অসতর্কতাবশতঃ পড়ে যাবে। মেঝেতে বসে পড়বে) খোদা!
[বুয়া দাদিমাকে ধরতে যাবে]
বুয়া : ওহ আল্লাহ্। দাদিমা! কি অইয়া গ্যালো।
[কষ্ট- হতাশা নিয়ে দাদিমা বুয়ার দিকে তাকাবে। দাদিমা নিজে লাঠি ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে]
দাদিমা : হয়েছে, থামো। ধরতে হবেনা আমাকে। বাক্সগুলো ধরবে না তুমি।
বুয়া : ক্যা, আছে কি আম্নের বাস্কের মধ্যে? কন তো এট্টু।
[বুয়া কৌতুহলবশত আবার বাক্সগুলো ধরতে যাবে। দাদিমা আবার তার লাঠি দিয়ে বুয়াকে আলতো গুঁতো দিবে]
দাদিমা : তুমি কি বুঝবে এসবের। মাথায় যদি থাকতো বুদ্ধি, আসতে না এর মধ্যে!
বুয়া : এহ! মোর বুদ্ধিভরা ঘিলু। কন কি আম্নে!
দাদিমা : বুদ্ধি না ছাই! বাবুর আম্মুর সাথে থেকে থেকে…. কথায় আছে, সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।
[বুয়া অবাক হয়ে দাদিমার দিকে তাকাবে]
বুয়া : লোহা আবার ক্যামনে ভাসে? থাউক, আম্নে কন, রাখছেন কি বাস্কগুলায়?
দাদিমা : তোমাকে বলে কী লাভ! ৮৬ বছরের জীবন আমার। আছে কিছু ছবি, কিছু স্মৃতি। কি
পেলাম জীবনে?
বুয়া : ওরে মোর আল্লাহ্, দাদিমা যে কি কন! আমি তো…..
দাদিমা : হয়েছে, বুঝতে হবে না তোমাকে।
বুয়া : কন এট্টু। আম্নেও আপার মতো করেন ক্যান?
দাদিমা : (ধমকের সুরে) তুমি তোমার কাজ কর। শুধু মনে রাখবে, ভুলেও বাক্সগুলো ধরবে না।
বুয়া : থাহেন আম্নে আম্নের এই বাস্ক নিয়া।
[দাদিমার প্রস্থান]
বুয়া : (ফিসফিস করে বলবে) বুড়া বয়সে ভিমরতিতে ধরছে…হিহিহি…
[বুয়ার প্রস্থান]
[স্টেজে বাবুর আম্মু ও বাবুর আব্বুকে আবার দেখা যাবে, দাদিমার প্রবেশ]
দাদিমা : বুড়ো মানুষের কথা কে ভাবে এখন?
[বাবুর আম্মু দাদিমাকে দেখেও না দেখার ভান করবে]
বাবুর আব্বু : কেন, দাদিমা? কি হয়েছে?
বাবুর আম্মু : ( ফিসফিস করে বলবে) আবার শুরু করেছে নাটক।
দাদিমা : কি আর হবে! কোনো খেয়াল রাখো নাকি আমার। আমারও তো হাত-খরচের টাকার
দরকার হয় নাকি।
বাবুর আম্মু : বুড়ো মানুষের আবার কিসের হাত-খরচ!
দাদিমা : তুমি আসলেই আমার মেয়ে তো?
[বাবুর আম্মু রাগান্বিত হয়ে দাদিমার দিকে তাকাবে]
বাবুর আব্বু : দাদিমা, আমি আছি তো। চিন্তা করবেন না একদম। আপনার হাত- খরচের ব্যবস্থা
আমি করব।
বাবুর আম্মু : ছিঃ দাদিমা। তোমাকে নিয়ে আর পারি না। লজ্জায় মরে যাচ্ছি আমি।
দাদিমা : নিজের দিকে তাকিয়ে কথা বলো, তুমি।এ কথা বলার উপযুক্ত সময় এটাই। তুমি চাইলে, তাহলে আমাকে প্রথমেই বিদায় করতে পারতে।
বাবুর আব্বু : (ব্যথিত হয়ে) দাদিমা, এসব বলতে হয় না!
দাদিমা : ( বাবুর আব্বুকে) বলতে দাও আমাকে।
(বাবুর আম্মুকে) কি করেছ আমার জন্য তুমি? বাবুর আব্বুকে বলে আমার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতে। হয় উলের ব্যবসা করতাম, না হয় রাধুনি হতে পারতাম। কিন্তু না! তুমি কিছুই করো নি এসবের।
বাবুর আব্বু : বাবুর আম্মু, তুমি তো এসব কিছুই আমাকে বলো নি।
[বাবুর আম্মু শুনেও না শোনার ভান করবে। পরিবেশ প্রতিকূল ভেবে, সে বই পড়ার ভান করবে কিন্তু শুনবে দাদিমা কি বলছে]
দাদিমা : (বাবুর আব্বুকে) ওর বলার কি আছে?
(বাবুর আম্মুকে) তুমি তো চেয়েছিলে, আমি এখানে থেকে তোমার সংসার আগলে রাখি। কিন্তু এখন আর এসবের প্রয়োজন নেই। কারণ, তোমার সাথে সংসার করার মন বাবুর আব্বুর উঠে গেছে। পারলে তো বাবুর আম্মু আমার সাথেই সংসার করতো। তাই না বাবুর আব্বু?
বাবুর আম্মু : বাবুর আব্বু এখন কারো সাথেই সংসার করতে চায় না, সে এমনিতেই অসুস্থ।
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, আমি এমনিতেই অসুস্থ। আমি কিছুই করতে চাই না।
বাবুর আম্মুঃ দেখেছো, আমি বলেছিলাম না?
বাবুর আব্বু : আমি শুধু এসব থেকে মুক্তি চাই।
বাবুর আম্মু : কিন্তু ওরা এত দেরি করছে কেন? কেন ওরা সময়মতো আসতে পারে না?
দাদিমা : কে? কে? কার কথা বলছো? কে আসবে?
বাবুর আম্মু : (বিরক্তিভাবে) তুমি মনে হয় জানো না কে আসবে!
দাদিমা : আমি সত্যিই জানি না।
বাবুর আম্মু : তুমি জানো বা না জানো তাতে কিছুই যায় আসে না।
বাবুর আব্বু : তুমি এটা কি বলছো?
বাবুর আম্মু : ঠিক বলেছি। (স্বাভাবিকভাবে, আগ্রহের সাথে) দেখ, কত সুন্দর করে দাদিমা
বক্সগুলো র্যাপিং করেছেন!
দাদিমা : সত্যি বলতে, আমার র্যাপিং করতে একটুও ভাল লাগেনা, এতে আমার আঙুলে ব্যথা
হয়।
বাবুর আম্মু : কেন, দাদিমা?
দাদিমা : তা তোমার না জানলেও চলবে।
বাবুর আম্মু : তুমি ঘুমাতে যাও।
দাদিমা : আমার ঘুমের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। আমি এখন ঘুমাবো না। আমি এখন
এখানেই থাকবো আর দেখবো কারা আসছে। তাছাড়া…
বাবুর আম্মু : ঘুমাতে যাও বলছি।
বাবুর আব্বু : দাদিমাকে জোর করো না, এখনতো দুপুরও হয়নি।
দাদিমা : হ্যাঁ, আমি দেখতে চাই। তাছাড়া…
বাবুর আব্বু : তাকে দেখতে দাও, বাবুর আম্মু।
বাবুর আম্মু : ঠিক আছে, তুমি দেখতে পারো। কিন্তু একটা কথাও আর বলতে পারবেনা।
দাদিমা : বৃদ্ধ মানুষ বলতে নয়, শুনতে ভালবাসে। সুতরাং, অবশ্যই আমি চুপ থাকবো।
বাবুর আব্বু : দাদিমা রাঁধুনী হতে চান, আগে কখনো বলোনি তো।
বাবুর আম্মু : ওহ তোমাকে বলা হয়নি। এটা অনেক আগের কথা।
[কলিংবেল বেজে উঠল]
বাবুর আম্মু : তারা কি এসে পড়েছে?
[বুয়ার প্রবেশ]
বাবুর আম্মু : তুমি এখানে?
বুয়া : আপা, আপনে তো মোর গত মাসের বেতনই দ্যান নাই।
বাবুর আম্মু : কই, দিয়েছি তো।
বুয়া : না,না, দ্যান নাই আপনে। সারাদিন তো শপিং করতে পারেন। বেতন দেয়ার ব্যালায় নাই। হাতে হাতে দিবেন, নাইলে বিকাশ বা নগদে।
বাবুর আম্মু : আচ্ছা, তোমাকে বিকাশেই দিয়ে দিব।
[বুয়া চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে। কিছু একটা চিন্তা করে আবার ফেরত আসবে]
বুয়া : না থাক, আপনে নগদেই দিয়েন।
বাবুর আম্মু: (বিরক্ত নিয়ে) আচ্ছা, ঠিক আছে।
[বাবুর আম্মুর প্রস্থান]
বুয়া : দেশি জিনিসই ভাল। দেশি নগদে লাভ বেশি।
[বুয়ার প্রস্থান]
[আবার কলিং বেল বেজে উঠল]
বাবুর আম্মু : তারা কি সত্যিই এবার চলে এসেছে?
দাদিমা : কারা এসে পড়েছে?
বাবুর আম্মু : (তাচ্ছিল্যের সাথে) ঐ… কিছু মানুষ!
দাদিমা : গাড়ির ড্রাইভার? ওরা কি সেই গাড়ির ড্রাইভার? শেষ পর্যন্ত তোমরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমেই পাঠাচ্ছো! যদিও এতে আমার কিছু যায় আসে না।
বাবুর আব্বু : না দাদিমা, তা হবে কেন! অবশ্যই না।
দাদিমা : অত নিশ্চিত হয়ো না। ওকে আমার বিশ্বাস নেই। ও যদি চায়, তবে তোমাকেও আমার সাথে পাঠিয়ে দিতে ওর দ্বিধা হবে না।
বাবুর আম্মু : তার কথা শোনার দরকার নেই, বাবুর আব্বু।
(জনান্তিকে দাদিমাকে) ওহ আল্লাহ্! তুমি এত অকৃতজ্ঞ!
[কলিংবেল আবার বেজে উঠল]
বাবুর আব্বু : (উৎকন্ঠার সাথে) আমি কি বলি শোনো…
বাবুর আম্মু : (জনান্তিকে দাদিমাকে) একটু দাঁড়াও, আমি তোমার ব্যবস্থা করছি! (বাবুর আব্বুকে) তাদেরকে ভিতরে নিয়ে এসো। কিসের জন্য অপেক্ষা করছো?
বাবুর আব্বু : আমাদের মনে হয় নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে আরেকটু কথা বলে নেয়া ভালো। আমার মনে হয়, আমরা একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছি।
[কলিংবেল আবার বেজে উঠল]
আমি এ বিষয়ে আরেকটু কথা বলতে চাই।
বাবুর আম্মু : তার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি না বেশ চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে!
বাবুর আব্বু : কিন্তু খুঁটিনাটি বিষয় গুলো বিবেচনা…
বাবুর আম্মু : আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাইনা। যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে সেটাই কার্যকর হবে। দরজা খুলে দাও।
বাবুর আব্বু : আসলে আমি নিশ্চিৎ না যে…
বাবুর আম্মু : (বিরক্তি সহকারে) বলছি না দরজা খুলে দাও!
বাবুর আব্বু : আমি কি এ বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম?
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, অবশ্যই ছিলে।
বাবুর আব্বু : আমি কি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম?
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, চূড়ান্তই নিয়েছিলে, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম শুনে।
বাবুর আব্বু : আমি কি সুপুরুষের পরিচয় দিয়েছিলাম?
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, বাবুর আব্বু, তুমি তো সুপুরুষের পরিচয়ই দিয়েছিলে! আমি সত্যিই অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
দাদিমা : (অবিশ্বাসের সুরে, ভেংচি কেটে) ভয় পেয়েছিল ও!
বাবুর আম্মু : তুমি চুপ করো।
দাদিমা : বৃদ্ধ মানুষের নিজের সাথে কথা বলার অধিকার আছে। এতে কোনো ক্ষতি নেই কারো।
বাবুর আব্বু : আমি তাহলে দরজাটা খুলতে যাচ্ছি।
বাবুর আম্মু : বাহ! এইতো, কি সুপুরুষ তুমি! বাবুর আব্বু কি সুপুরুষ না, দাদিমা?
দাদিমা : আমার কাছ থেকে কিছু শোনার আশা করোনা। বৃদ্ধদের কথা তো তোমাদের কাছে বিশ্রী লাগে।
বাবুর আম্মু : তোমার সব কথা কিন্তু খারাপ না, তুমি হয়তো সেটা জানো।
বাবুর আব্বু : (দরজার সামনে গিয়ে আবার ঘুরে) আমরা মনে হয় তাদের চলে যেতে বলতে পারি।
বাবুর আম্মু : বাহ! বাহ! তার অবস্থাটা দেখো! একদম মেয়ে মানুষের মতো করছে! কাপুরুষ কোথাকার!
বাবুর আব্বু : ঠিক আছে, দেখো, আমি দরজা খুলতে যাচ্ছি।
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, আমরা দেখছি।
দাদিমা : আমি দেখছি না।
বাবুর আব্বু : এখন দেখ, এটা খুলে যাচ্ছে।
[সে দরজা খুলতে থাকে]
ওহ! দরজা খুলে গেছে!
[মিসেস চৌধুরীর কক্ষে প্রবেশ]
তারা এসে গেছে!
বাবুর আম্মু : এইতো তারা এসে গেছে!
দাদিমা : কই? কোথায়?
বাবুর আব্বু : আসুন, ভিতরে আসুন। আপনার আসতে দেরি হয়ে গেছে। অবশ্য আমরা জানতাম আপনার আসতে দেরি হবে। আমরা আসলে এ বিষয়ে কথা বলছিলাম।
বাবুর আম্মু : বাবুর আব্বু, অভদ্র ভাবে কথা বলো না। আমরা আসলে বলছিলাম যে বর্তমানে কোনো কিছুতেই সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না। অবশ্য আমরা আপনাকে নিয়েও কথা বলছিলাম। আপনি কি ভিতরে আসবেন না?
মিসেস চৌধুরী : জ্বী, অবশ্যই। ধন্যবাদ।
বাবুর আম্মু : আমরা অনেক খুশি হয়েছি যে আপনি এখানে এসেছেন। আপনি আমাদের চিনতে পেরেছেন তো? আপনি আগেও একবার এখানে এসেছিলেন। আমি বাবুর আম্মু, এই হলো বাবুর আব্বু, আর ঐ যে কর্ণারে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে, উনি হলেন দাদিমা।
মিসেস চৌধুরী : হ্যালো, বাবুর আম্মু। হ্যালো, বাবুর আব্বু। হ্যালো, দাদিমা।
বাবুর আব্বু : আপনি তাহলে শেষ পর্যন্ত আসলেন। অন্য সময়ে আসবেন বলে চলে যাবেন না আশা করি!
মিসেস চৌধুরী : না, না, আমি চলে যাচ্ছি না। এই যে দাদিমা, হ্যালো!
বাবুর আম্মু : ওনার সাথে কথা বলো, দাদিমা।
দাদিমা :আমি কাউকে দেখছি না।
বাবুর আব্বু : ছিঃ দাদিমা! উনি তো এখানেই।
মিসেস চৌধুরী : হ্যাঁ, দাদিমা, আমি তো এখানেই। আমি মিসেস চৌধুরী। আপনার কথা আমার মনে আছে। আপনি কি আমাকে ভুলে গেছেন?
দাদিমা : আমি মনে করতে পারছি না। সম্ভবত তখন তোমার বয়স কম ছিলো, অথবা এমন কিছু হবে!
বাবুর আম্মু : (একটু বিরক্তিতে) দাদিমা! এসব কি ভুলভাল বলছো তুমি!
মিসেস চৌধুরী : ওনাকে বকবেন না, বাবুর আম্মু। উনি হয়তো ঠিকই বলেছেন!
বাবুর আব্বু : উহ…(নাম মনে করার চেষ্টা করে) মিসেস চৌধুরী…তাই না? আপনি কি বসবেন না?
মিসেস চৌধুরী : জ্বী, অবশ্যই। ধন্যবাদ।
দাদিমা : তারা কি এখনো এখানে আছে?
বাবুর আম্মু : চুপ করো তুমি!
মিসেস চৌধুরী : হ্যাঁ, আমি তো এখনো এখানে আছি, দাদিমা। তবে…আপনাদের ফ্লাটটা মোটেই সুন্দর না।
বাবুর আম্মু : ঠিক বলেছেন। এখানে বেশ কিছু সমস্যা আছে। আমি আপনাকে বলছি…
বাবুর আব্বু :আমি আর বাবুর আব্বু তো এ বিষয়েই কথা বলছিলাম…
মিসেস চৌধুরী : এবং ওয়াশরুম নিয়ে কথা হচ্ছিল। সত্যি বলতে, আমরা খুবই কর্মদক্ষ। কাজের জন্য আমাদের অনেক কিছুই জানতে হয়।
বাবুর আব্বু : আপনি আসলে কি কাজ করেন?
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, আপনার আসলে কাজটা কী?
মিসেস চৌধুরী : ওহ, আমি! প্রথমত, আমি ধানমন্ডি উইমেন্স ক্লাবের চেয়ারম্যান…
বাবুর আম্মু : কি যা তা বলছেন? আমি গতদিনই তার সাথে কথা বলে…ও! তাহলে আপনিই সেই ভদ্রমহিলা? বাবুর আব্বু, তোমার মনে আছে আমি তোমাকে বলেছিলাম একজন মহিলার কথা যার স্বামী সারা দিন হুইলচেয়ারে বসে থাকে? মনে পড়ে?
বাবুর আব্বু : কই না তো। আমারতো এমন কিছুই মনে পড়ছেনা।
বাবুর আম্মু : আরে না, তোমার মনে আছে। আপনি কিছু মনে করবেন না মিসেস চৌধুরী। আসলে লাইটের আলোতে হঠাৎ দেখে আপনাকে চিনতে পারিনি। আর দেখুন… আপনিও তো ঠিক আমার মত ব্যাগ কিনেছেন।
মিসেস চৌধুরী : আমি তো ব্যাগটা আড়ং থেকে নিয়েছি। এটা আপনার মতো না, এটা তো ক্রিম কালার।
বাবুর আম্মু : এটা আপনার কাছে ক্রিম কালার মনে হতেই পারে। কিন্তু এটা আসলে…
মিসেস চৌধুরী : আচ্ছা এখন এসব কথা থাক, কাজের কথা বলুন। আমার হাতে বেশি সময় নেই।
বাবুর আম্মু : আপনি তো মাত্রই আসলেন। আগে কিছুক্ষণ বসুন তারপর না হয় কাজের কথায় আসা যাবে।
মিসেস চৌধুরী : জ্বী…তা অবশ্য মন্দ বলেননি।
বাবুর আম্মু : এখন বলেন, কি খাবেন? ঠান্ডা না গরম?
মিসেস চৌধুরী : কিছু একটা হলেই হচ্ছে, তবে আমি মিষ্টি একটু বেশি খাই।
বাবুর আম্মু : আমাদের বাড়িতে তো সবার ডায়াবেটিস। কেউ মিষ্টি খায় না।
বাবুর আব্বু : খাবে না কেন? দাদিমা তো রোজ মিষ্টি টোস্ট আর রং চা খায়,
তাই না, দাদিমা?
দাদিমা : কী জানি বাপু? আমার তো মনে পরেনা!
বাবুর আম্মু : আচ্ছা মিসেস চৌধুরী, আপনি কি জানেন আপনাকে আমরা কেন ডেকেছি?
[হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো]
বাবুর আম্মু : (বিরক্তির সাথে) সময় নেই অসময় নেই কে যে আসে!
(দরজা খুলে) কে আপনি?
[দরজার ওপাশে আক্কাসকে দেখা যাবে]
আক্কাস : আসসালামু আলাইকুম। আমি আক্কাস। এটা কি বাবুর আব্বুর বাসা?
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ। কী দরকার?
আক্কাস : আমি শাটুরিয়া থেকে এসেছি। বাবুর আব্বুর গ্রামের বাড়ির পাশের আমার বাড়ি। আগামীকাল আমার একটি চাকরির পরীক্ষা আছে…
বাবুর আম্মু : কিসের চাকরি শুনি?
আক্কাস : সরকারি অফিসের পিয়ন।
বাবুর আম্মু : পিয়ন! তোমার লেখাপড়া কতদূর? রেজাল্ট কেমন?
আক্কাস : আমি অনার্স পাশ। এসএসসি তে এ প্লাস; আই মিন; আই এম জিপিএ ফাইভ!
বাবুর আম্মু : তো আমরা কি করতে পারি?
আক্কাস : আসলে, বাবুর আব্বু ছাড়া ঢাকায় আমার কেউ নেই…উনিই আমাকে আসতে বলেছিলেন। আজ রাতটা আপনাদের এখানে থাকতে চাই।
বাবুর আম্মু : থাকতে চাই বললেই হলো নাকি? এত ছোট ফ্লাটে আমাদের নিজেদেরই থাকার জায়গা হয়না আবার তোমাকে কোথায় থাকতে দিবো?
আক্কাস : একটা রাত যদি একটু…
বাবুর আম্মু : না, না…এখানে কোন থাকার জায়গা নেই। যাও এখন তুমি।
আক্কাস : বাবুর আব্বুর সাথে কি একটু দেখা করা যাবে?
বাবুর আম্মু : বাবুর আব্বু বাসায় নেই। এখন দেখা হবে না।
আক্কাস : আচ্ছা, আসি।
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, যাও যাও…
[আক্কাসের প্রস্থান]
(দরজা বন্ধ করতে করতে) যত্তসব উটকো ঝামেলা।
বাবুর আব্বু : কে আসলো?
বাবুর আম্মু : ওসব জেনে তোমার কাজ নেই। তুমি নিজের কাজে মন দাও।
[বক্সের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসতেই…]
দাদিমা : আরে…আরে…আমার বাক্স…আমার বাক্স…
বাবুর আম্মু : (বিরক্তি) চুপ কর দাদিমা। কিসব জিনিস রেখে দিয়েছ পথের মাঝে?
[বাবুর আম্মু কয়েকটি বক্স মাড়িয়ে যেতে লাগলে]
দাদিমা : হায়…হায়…গেলো…গেলো…
মিসেস চৌধুরী : বক্স! উনি বক্সের কথা বলছেন।
বাবুর আব্বু : আপনার এই বক্সগুলো দিয়ে কি হবে, দাদিমা? মিসেস চৌধুরী কি এই বক্সগুলো নিতে এসেছেন? আপনি কি তাই বোঝাতে চেয়েছেন, দাদিমা?
দাদিমা : আমি কী বোঝাতে চেয়েছি আমি নিজেই জানি না।
বাবুর আব্বু : দাদিমা, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে…
মিসেস চৌধুরী : তাহলে এই বক্সগুলো কি আমার জন্য? আপনারা কি আমাকে এই বক্সগুলো নিতে ডেকেছেন?
বাবুর আম্মু : কেন…আপনি কি বক্স সংগ্রহ করে বেড়ান?
বাবুর আব্বু : ভালোই বলেছো!
মিসেস চৌধুরী : না, আপনারা আমাকে কেনো ডেকেছেন তা তো আপনারা ভালো জানেন। আসলে আমি একটি সংস্থার সাথে জড়িত যেখানে আমরা বসত বাড়ির অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করি। এজন্যই জিজ্ঞাসা করেছি। আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছন।
বাবুর আব্বু : চমৎকার…আপনিতো মহৎ কাজের সাথে জড়িত।
মিসেস চৌধুরী : আমিও তাই মনে করি। যদি কখনো কোনো সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে আমাকে জানাবেন।
বাবুর আব্বু : আমার কিছু অসুস্থতা আছে।
বাবুর আম্মু : অসুস্থতা? কি হলো আবার? তোমার কি বুকের ব্যাথাটা বেড়েছে?
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, আজকাল বুকের ব্যাথাটা একটু বেড়েছে।
বাবুর আম্মু : জানেন মিসেস চৌধুরী, বাবুর আব্বুর হার্ট বাইপাস করা।
মিসেস চৌধুরী : আমি সত্যিই খুব দুঃখিত…আমি জানতাম না।
দাদিমা : এটা নিয়ে এতো দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই।
বাবুর আম্মু : তুমি বড্ড বেশি কথা বলো।
দাদিমা : এইতো নিজের রূপ দেখাচ্ছো। সবাই বৃদ্ধদের বোঝা মনে করে দূর করে দিতে চায়। এখন আমি নিঃস্ব, চোখে ছানি পড়েছে, গায়ে বল নেই, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিনা। আমি নিঃসঙ্গ, কিন্তু তা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কেউ আমার কথাও শোনে না, মানুষ ভাবে এটা বৃদ্ধ বয়সের দোষ। বৃদ্ধ মানুষ হয়ে গেছে সমাজের বোঝা! (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) এই আর কি!
মিসেস চোধুরী : আচ্ছা, বাবুর আব্বুর কি হয়েছিলো?
বাবুর আব্বু : তেমন কিছু না। হার্টের ভাল্ভ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
মিসেস চৌধুরী : আপনি তো মশাই বেশ ভাগ্যবান। এতোকিছুর পরও বেঁচে আছেন।
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। উনি প্রথমে মন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। তবে এখন তিনি মেয়র হতে চান যাতে তিনি পরিবারের সাথে থাকতে পারেন।
মিসেস চৌধুরী : তাহলে তো আপনি সত্যিই ভাগ্যবান।
বাবুর আব্বু : তা অবশ্য ঠিক, তবে বুকের ব্যাথাটা নিয়ে একটু চিন্তায় থাকি।
মিসেস চৌধুরী : এসব নিয়ে ভাববেন না। আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার সুস্থতা কামনা করি।
বাবুর আম্মু : কি হলো? চুপ করে আছো কেন? মিসেস চৌধুরী কে ধন্যবাদ জানাও।
বাবুর আব্বু : আপনাকে ধন্যবাদ।
মিসেস চৌধুরী : জানেন তো…আমার ছোট ভাইটা একদম আপনার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী। যদিও সে আপনার মতো বয়স্ক নয়। এমনকি সে আমার থেকেও অনেক ছোট। সম্ভব হলে সে নিজের একটি ফাইভস্টার হোটেল দেয়। তবে তার একটি ডেকোরেটরের দোকান আছে, তার নিজেরই দোকান। সে কারো অধিনস্থ হয়ে কাজ করতে নারাজ। সে সত্যিই অনেক প্রতিভাবান, কিন্তু সে এটা স্বীকার করতে চায় না।
বাবুর আম্মু : বাহ, এটাতো বিশাল ব্যাপার! তাই না, বাবুর আব্বু?
বাবুর আব্বু :হ্যাঁ…হ্যাঁ…বিশাল ব্যাপার।
মিসেস চৌধুরী : আমার ভাইটা খুবই ভালো, তার বউটাও অনেক মিষ্টি। বউ ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না, বউয়ের কথায় ওঠে আর বসে, আর ওর মুখে সারাদিন বউ আর শ্বশুরবাড়ির গল্প। এমন বউপাগলা আমি আর দুইটা দেখিনি। এক্ষেত্রে তার নাম গিনেজ বুকে থাকারই মতো!
বাবুর আব্বু : তাই নাকি?
বাবুর আম্মু : এটা সত্যিই মজার…
মিসেস চৌধুরী : হুম…আমিও তাই মনে করি। যদিও আমাদের সমাজে এর বিপরীত চিত্রই বেশি দেখা যায়।
দাদিমা: তাই? জানতাম না তো!
বাবুর আম্মু: তবে… আমার বিষয়টা চমৎকার লেগেছে। তুমি কি বলো, বাবুর আব্বু?
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ…হ্যাঁ…আমিও তাই মনে করি।
দাদিমা : আমি বলছিলাম যে…
বাবুর আম্মু : থামো তুমি।
দাদিমা : (ভেংচি) হুহ!
বাবুর আম্মু : আহা…মিসেস চৌধুরী কিছু মনে করবেন না। উনি এমনই…
মিসেস চৌধুরী : (একটু হেসে) না…না…কিছু মনে করিনি।
বাবুর আব্বু : মনে হয় দাদিমা কিছু বলতে চান।
বাবুর আম্মু : আহাম্মক…বৃদ্ধদের কিছু বলার থাকেনা। আর যদিও বা তারা কিছু বলে, তাদের কথা কেউ শোনেনা। (দাদিমার দিকে তাকিয়ে) দেখেছো? আমিও তোমার মতো ভাষণ দিতে পারি।
দাদিমা : হ্যাঁ…তুমি আমার সুরে বলতে পারলেও আমার মতো করে বলতে পারো নি কারণ তোমার সে বয়স হয়নি। তুমি তো মধ্যবয়সী।
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ। এজন্য আমি গর্বিত।
দাদিমা : দেখো, কথা কিভাবে বলতে হয় আমি তোমাকে দেখাচ্ছি। মধ্যবয়সী মানুষেরা মনে করে তারা চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারে। কিন্তু সত্য এটাই যে, তারা অনেক কিছুই করতে পারে না যা তারা আগে করতে পারতো। তারা মনে করে, তারা সবার মতই স্পেশাল। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের শক্তি সামর্থ্যও কমতে থাকে। শুধু সুর থাকলেই হয় না, কথাও জানতে হয়!
বাবুর আব্বু : ইশ…এখানে যদি কিছু পুরুষ থাকতো! এতো মহিলাদের মধ্যে আমার ভাল লাগছে না।
মিসেস চৌধুরী : কী বললেন!…আবার বলুন।
দাদিমা : আমি বুড়ো মানুষ, আমার আর ছেলে মেয়ে কী? তুমি আমাকে পুরুষ ভাবতে পারো। আমি কি এখন আমার কথাটা বলতে পারি?
বাবুর আম্মু : হুম, চালিয়ে যাও তোমার বাজে বকা।
দাদিমা : আমি বলতে চাচ্ছি যে, এ বাক্সগুলোতে এমন কোন জিনিস নেই যেটা নিতে মিসেস চৌধুরী এখানে এসেছেন। এখন যদি তোমরা জানতে চাও এ বাক্সগুলোতে কী আছে…
বাবুর আব্বু : আমার মনে হয় দাদিমা ঠিকই বলছেন। কিন্তু এই সবকিছুর সাথে মিসেস…উম…মাফ করবেন। আপনার নাম টা কি যেন?
মিসেস চৌধুরী : মিসেস চৌধুরী…
বাবুর আব্বু : আচ্ছা, তাহলে এবার আমাকে বলো এইসবের সাথে মিসেস…নাম টা কি যেন?
মিসেস চৌধুরী : মিসেস চৌধুরী।
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, হ্যাঁ… এবার তাহলে বলো এসবের সাথে মিসেস…মিসেস…(মাথা চুলকাবে এবং বাবুর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলবে) আচ্ছা…ভদ্র মহিলার নামটা যেন কী?
বাবুর আম্মু : (বাবুর আব্বুর কথায় কান না দিয়ে) উনি এখানে আমদের কাজে এসেছেন।
মিসেস চৌধুরী : জ্বী…জ্বী..ঠিক তাই।
দাদিমা : এখন যদি তোমরা জানতে চাও এই বাক্সগুলোতে…
বাবুর আম্মু : (অবজ্ঞার সুরে) নাহ…কেউই তা জানতে আগ্রহী না।
দাদিমা : দেখি তোমার এই স্বভাব তোমার কতটা উপকারে আসে!
বাবুর আব্বু : আহা! তোমরা ঝগড়া থামাবে!
বাবুর আম্মু : কে ঝগড়া করছে ওনার সাথে!
বাবুর আব্বু : যাইহোক না কেন, থামো এবার।
বাবুর আম্মু : কেনযে তুমি ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দাও না!
দাদিমা : থাক, থাক, এজন্য আর তোমাদের কষ্ট করতে হবে না।
বাবুর আব্বু : এখনও থামলে না? এখন দেখছি আমাকেই চলে যেতে হবে…
বাবুর আম্মু : (দাদিমার দিকে তাকিয়ে) এর একটা বিহিত করতেই হবে। এভাবে চলা তো অসম্ভব। এমনিতেই এই বাড়িতে অনেক মানুষ। আর যেখানেই চোখ যায় সবই তো তোমার জিনিস। তোমার পানের কৌটা, তোমার বিড়াল, আল্লাহই জানে আরো কতকিছু…আর তারপর তো এই বক্সগুলো এসে জুটেছে।
দাদিমা : আরে ওগুলোর মধ্যেই তো…
মিসেস চৌধুরীঃ পানের কৌটা…!
দাদিমা : ওহ, ওটা পানের বাটা হবে। কিন্তু বাবুর আম্মু এর পার্থক্যটা বোঝে না। আসলে ওর বুদ্ধি-জ্ঞান আগাগোড়াই একটু কম…ওর স্কুলমাস্টাররা বলতো ওর মাথায় গোবর ভরা।
বাবুর আম্মু : দেখেছো, বাবুর আব্বু? দেখেছো? দাদিমা কীসব বলছে আমার নামে! সারাজীবন এতো কিছু করার পরও আজ আমাকে এই দিন দেখতে হলো! (দাদিমার দিকে তাকিয়ে) দাড়াও… এর মধ্যেই যদি তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠাই তবে আমিও বাবুর আম্মু না!
দাদিমা : দেখা যাক!
মিসেস চৌধুরী : মাথায় গোবর ভরা!
দাদিমা : হুম..ঠিক তাই।
বাবুর আম্মু : (মিসেস চৌধুরীকে) আপনি দাদিমার কথায় কান দিবেন না। সে যা তা বলে। মাঝে একদিন সে বাবুর আব্বুকে কুয়োর ব্যাঙ বলেছিল।
মিসেস চৌধুরী : না, তিনি এটা বলতে পারেন না!
দাদিমা : আমি জানতাম তুমি আমার পক্ষে।
বাবুর আম্মু : আমি বুঝি না সে এসব ভাষা কোথা থেকে শিখেছে। টিভি দেখে, তাই না?
মিসেস চৌধুরী : আপনি কি সত্যিই তাকে কুয়োর ব্যাঙ বলেছিলেন?
দাদিমা : আমি বলি আর না বলি তাতে কি আসে যায়!
বাবুর আব্বু : দাদিমা ঠিক বলেছেন। তাকে তার মতো থাকতে দাও তো।
বাবুর আম্মু : (বাবুর আব্বুকে) তোমার এত বড় স্পর্ধা!
দাদিমা : ওরে বাবুর আব্বু, ওর কথায় কান দিও না। ও সবকিছু গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছে।
বাবুর আম্মু : দেখেছো? আমি তোমাকে বলেছিলাম না? এগুলো সব টিভি দেখার ফল। (জোরালো ভাবে) তুমি এখনই দাদিমার রুমে যাও আর টিভিটা নিয়ে এসো।
বাবুর আব্বু : আচ্ছা, বিষয়টা আমি দেখছি। এখনো কিন্তু ওনার আসার উদ্দেশ্য জানা হলো না।
দাদিমা : আমি জানি সে এখানে কেন এসেছে।
বাবুর আম্মু : তুমি থামো।
মিসেস চৌধুরী : ওহ, আমি ভেবেছিলাম আপনারাই আমাকে বলবেন।
বাবুর আম্মু : না, না, একেবারেই না। আমরা কেন বলবো?
বাবুর আব্বু : আপনাকে আমরা ডেকেছি বলেই তো আপনি এসেছেন।
মিসেস চৌধুরী : আপনারা ডেকেছেন বলেই আমি এখানে এসেছি। কিন্তু আমি জানিনা কেন আপনারা আমাকে ডেকেছেন। আমি আসলে এই কমিটি ওই কমিটি নিয়ে অনেক ব্যস্ত। তাছাড়া আমি উন্নয়ন কমিটিতেও কাজ করছি।
বাবুর আম্মু : ওমা, আপনি এত ব্যস্ত!
মিসেস চৌধুরী : হ্যাঁ, আসলেই। তাই আমার মনে হয় আপনারা আমাকে সাহায্য করার জন্য ডেকেছেন।
বাবুর আম্মু : না, না, আপনার মনে হয় ভুল হচ্ছে। আমরা আপনাকে অবশ্যই সাহায্যের জন্য ডাকি নি। আর এই চড়া বাজারে আপনাকে আমরা কোনকিছু দিয়েই সন্তুষ্ট করতে পারবো না। আমার মনে হয় না আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবো।
বাবুর আব্বু : তাছাড়া আপনার সত্যিই যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে তো আপনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাহায্য নিতে পারেন।
বাবুর আম্মু : তা যদি না হয়, তাহলে আপনি বিভিন্ন সমিতি থেকে লোন নিতে পারেন।
দাদিমা : আরে, তুমি কেন “সেরা রাধুনি” প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছো না?
মিসেস চৌধুরী : আহ, আপনারা কত ভালো! আমাকে ভাবার সময় দিন। সামনের কয়েকদিন আমার প্রচুর ব্যস্ততা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটিতেও কাজ আছে। আপনারা নারী নির্যাতনকে কিভাবে দেখেন?
বাবুর আম্মু : না, না, আমরা এসব সহিংসতা একদম পছন্দ করিনা।
মিসেস চৌধুরী : হ্যাঁ, আসলে আপনাদের সেখানে কিছু করারও নেই। পৃথিবীটা আসলে এতো সহিংসতায় ভরে গেছে যে আমি আপনাদের বোঝাতে পারবো না।
দাদিমা : আসলে এ অবস্থায় বৃদ্ধরাও শান্তিতে নেই। সেদিন টিভিতে দেখলাম এক মেয়ে বলল, আমাদের দেশের ৮০% মানুষই ৯০ বছরের উপরে কিংবা ৯০% মানুষই ৮০ বছরের উপরে।
বাবুর আম্মু : তুমি আসলেই মিথ্যাবাদী। তুমি না ওইদিন বললে যে সবাই মধ্যবয়স্ক?
দাদিমা : আমি তো কেবল সেটাই বললাম যেটা টিভিতে বলেছে। সেটা নিয়ে আমার কিবা করার আছে।
বাবুর আম্মু : আবার সেই টিভি! বাবুর আব্বু, এখনই যেয়ে টিভিটা ভেঙ্গে ফেলো।
দাদিমা : তুমি ওটা খুঁজেই পাবে না।
বাবুর আব্বু : আমার যদি যেতেই হয়, তবে যাই…
বাবুর আম্মু : দেখো, বিড়ালটার গায়ের উপর দিয়ে যেয়ো না। ও কিন্তু অন্ধ।
বাবুর আব্বু : ওটা অন্ধ…আমি তো আর অন্ধ নই।
[বাবুর আব্বুর প্রস্থান]
দাদিমা : তুমি ওটাও খুঁজে পাবে না।
বাবুর আম্মু : আমি আসলে খুবই ভাগ্যবান এরকম একজন হাজবেন্ড পেয়ে। একবার ভাবো, আমার যদি এরকম একজন হাজবেন্ড থাকতো যে কিনা গরিব, অবাধ্য, সারাদিন হুইল চেয়ারে বসে থাকে…কি বলে ফেললাম আমি এটা!
দাদিমা : তুমি বলেছো, তোমার যদি এরকম একজন হাজবেন্ড থাকতো যে কিনা সারাদিন হুইল চেয়ার এ…
বাবুর আম্মু : (জিভে কামড় দিয়ে) এ আমি কি বলে ফেললাম! এর থেকে আমার জিভ খসে পড়তো। এর থেকে তো…
মিসেস চৌধুরী : (হাসার চেষ্টা করে) না, না, এসব নিয়ে ভাববেন না। আমি কিছু মনে করিনি।
বাবুর আম্মু : আমি দুঃখিত। আমি সত্যিই…
মিসেস চৌধুরী : না, না, এসব নিয়ে একদম ভাববেন না। সত্যিই আমি…
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি এটা নিয়ে একদম ভাববোই না। আমি একেবারেই ভুলে যাবো যে এ কথাটি আমি বলেছিলাম…(একটু বিরতি) এইতো ভুলেই গেলাম! আচ্ছা বাবুর আব্বু তো এখন এখানে নেই, আসুন আমরা কিছু মেয়েলি ব্যাপারে কথা বলি।
মিসেস চৌধুরী : আমি নিশ্চিত নই যে…
বাবুর আম্মু : আমার মনে হয় আপনি মেয়েলি ব্যাপারে আলাপ করতে চান না।
মিসেস চৌধুরী : আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম যে আমাকে কি এক গ্লাস পানি দেয়া যায়? আমার একটু দুর্বল লাগছে।
বাবুর আম্মু : দাদিমা, মিসেস চৌধুরীকে এক গ্লাস পানি দাও।
দাদিমা : আমি পারবো না। পারলে তুমি দাও।
বাবুর আম্মু : (মিসেস চৌধুরীকে) দাদিমা আসলে বাড়ির টুকিটাকি কাজগুলো করতে পছন্দ করে। এতে দাদিমার মনে হয় সেও এ বাড়ির একজন সদস্য।
দাদিমা : আমি বলেছিতো পারবো না।
বাবুর আম্মু : যা বলেছি ভালোয় ভালোয় করো…না হলে তুমি জানোই তোমার কি হবে! তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেব।
দাদিমা : আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এসবে আমি এখন আর ভয় পাই না। তাছাড়া…
বাবুর আম্মু : ঠিক আছে। আমি তোমাকে পরে দেখছি। আমি তোমার চশমা লুকিয়ে রাখবো।
দাদিমা : তুমি আমার কোন কিছুই খুঁজে পাবে না।
মিসেস চৌধুরী : আমার মনে হয় আমি এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।
বাবুর আম্মু : হায় আল্লাহ! আমি এখনি যাচ্ছি। (বাবুর আম্মু যেতে যেতে দাদিমাকে) আমি তোমার ব্যপার টা পরে দেখছি।
[বাবুর আম্মুর প্রস্থান]
দাদিমা : তোমার যা ইচ্ছা করো। (মিসেস চৌধুরীকে) তোমার এখন কেমন লাগছে?
মিসেস চৌধুরী : আগের থেকে একটু ভালো। ধন্যবাদ, দাদিমা।
দাদিমা : বেশ!
মিসেস চৌধুরী : কিন্তু, আমার কেমন যেনো বিস্মৃতি হচ্ছে…জানি না আমি কেন এখানে এসেছি…আবার তারা বলছে আমি নাকি এখানে আগেও এসেছি!
দাদিমা : হ্যাঁ, এসেছিলে। তবে এখানে না। অন্য একটা ফ্লাটে। যদি তুমি উপমা পছন্দ করো, তাহলে বলতে পারিঃ আমরা কার্সরের মত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দৌড়ে বেড়াচ্ছি।
মিসেস চৌধুরী : আমি আসলে উপমা পছন্দ করি না।
দাদিমা : তাহলে আমি দুঃখিত। তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না।
মিসেস চৌধুরী : (হঠাৎ করে) আমার মনে হয় আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি।
দাদিমাঃ অত নিশ্চিত হয়ো না। এ বাড়িতে নিজেকে ছাড়া কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না।
মিসেস চৌধুরী : ও, তাই নাকি! আমার মনে হয় আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি। আপনি আমাকে দয়া করে বলুন এ বাড়িতে আমাকে কেন ডাকা হয়েছে? আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।
দাদিমা : ও! আমার সত্যিই ভালো লাগছে যে অনেক দিন পর কেউ আমাকে কিছু বলতে অনুরোধ করলো। আমাকে আরও কয়েকবার অনুরোধ করো…
মিসেস চৌধুরী : বাবুর আম্মু যে আপনার মেয়ে তা বোঝাই যাচ্ছে!
দাদিমা : না, আমি কিন্তু ওভাবে বলতে চাইনি। তুমি যদি অনুরোধ না করো তাহলে অন্তত জিজ্ঞাসা করো, প্রার্থনা করো, নিবেদন করো, কিছু তো একটা করো…
মিসেস চৌধুরী : আপনি তো আসলেই একজন অদ্ভুত মানুষ!
দাদিমা : তা তুমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝবে…
মিসেস চৌধুরী : আমি এবার আপনাকে অনুরোধ করছি, প্রার্থনা করছি, মিনতি করছি…
দাদিমা : ওহ, মিনতি! এটা আমার জীবনে শোনা সবচেয়ে মধুর শব্দ। তুমি আসলেই চমৎকার একজন মহিলা। তুমি আমার কাছে মিনতি করেছো, আমি আর না বলে পারছি না।
মিসেস চৌধুরী : আচ্ছা এখন দয়া করে বলুন তারা আমাকে কেন ডেকেছে।
দাদিমা : আচ্ছা, তোমাকে তাহলে একটা গল্প বলি। আশা করি গল্পটা শুনে তুমি সব কিছু বুঝতে পারবে। তোমাকে তো সরাসরি কিছু বলতে পারছি না। জানোই তো, দেয়ালেরও কান আছে! সে অনেক বছর আগের কথা, প্রায় বিশ বছর হবে, এক দেশে ছিলো এক রাজা, তিনি অনেকটাই বাবুর আব্বুর মতো এবং রাজার ছিলো এক রানী, তিনি অনেকটাই বাবুর আম্মুর মতো। তাদের রাজপ্রাসাদটাও ছিল দেখতে অনেকটা এই বাড়ির মতোই। সে প্রাসাদে তাদের সাথে বাস করতো এক বুড়ি, যে কিনা একদম আমার মতো, কিন্তু একটু কম বয়স্ক, না…(একটু ভেবে) তারা সবাই তুলনামূলক কম বয়সী ছিলো। সে তো অনেক বছর আগের কথা।
মিসেস চৌধুরী : তারপর?
দাদিমা : সেই সময়ে সেইখানে একজন ভদ্রমহিলা ছিলো ঠিক তোমার মতো, তবে কমবয়সী। সেই মহিলা অনেক ভালো কাজ করে বেড়াতো, অনেকটাই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মতো, যেগুলো গরিব-দুঃখী ও এতিমদের সাহায্য করে।
মিসেস চৌধুরী : বাহ, মজার তো! তারপর?
দাদিমা : তবে রাজা রানীর মনে কোন সুখ ছিল না।
মিসেস চৌধুরী : কেন? সুখ ছিল না কেন?
দাদিমা : সুখ থাকবে কি করে বলো! তাদের সব কিছু ছিল কিন্তু তাদের সাত রাজার ধন ছিল না।
মিসেস চৌধুরীঃ মানে ধনসম্পত্তি?
দাদিমা : হ্যাঁ, সন্তানকে তো সম্পত্তি বলাই যায়! যাই হোক না কেন, তবে রানীটা, যে কিনা অনেকটা বাবুর আম্মুর মতো, তার একটা সন্তানের খুব শখ ছিল। সন্তান পাওয়ার প্রত্যাশায় তারা সেই ভদ্রমহিলা যে কিনা অনেকটাই তোমার মতো, তার কাছে যায় যেন সে তাদের একটা সন্তান এনে দিতে পারে।
মিসেস চৌধুরী : ইশ, কি যাচ্ছে তাই ব্যাপার!
দাদিমা : হুম, ঠিক তাই। তারপর, সেই ভদ্রমহিলা তাদের অনেকগুলো বাচ্চা দেখায় এবং তারা তাদের সাধ্যের মধ্যে সব থেকে সেরা বাচ্ছাটাকেই বেছে নেয়। বাচ্চা পেয়ে তারা খুব খুশি হয়। আর বাচ্চাটাকে ভালো দামে বিক্রি করতে পেরে ভদ্রমহিলাটিও অনেক খুশি হয়।
মিসেস চৌধুরী : হুম, খুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
দাদিমা : যাইহোক, তারা গরু ছাগলের মতো দামাদামী করে বাচ্চাটা কিনলো এবং খুশি মনে বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু এই আনন্দ বেশি দিন থাকলো না।
মিসেস চৌধুরী : কেন? কোন সমস্যা হয়েছিলো?
দাদিমা : সমস্যা তো হয়েই ছিল। (আশেপাশে তাকিয়ে) এখন তাড়াতাড়ি গল্প শেষ করতে হবে। আমার তো আবার যেতে হবে।
মিসেস চৌধুরী : আপনি কি সত্যিই চলে যাবেন?
দাদিমাঃ হুম!
মিসেস চৌধুরী : কিন্তু বৃদ্ধরা তো কোথাও যায় না। হয় তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়, নয়তো রেখে আসা হয়।
দাদিমা : তবে এই বৃদ্ধ মানুষটি সবার থেকে আলাদা। যাইহোক, দিনের পর দিন অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে।
মিসেস চৌধুরী : ও হ্যাঁ, তারপর?
দাদিমা : প্রথমত, ছেলেটা দেখতে বাবা-মা কারো মতোই ছিলো না, যার জন্য তারা বেশ অসন্তুষ্ট ছিলো। তাছাড়া, বাচ্চাটা দিন-রাত গলা ফাটিয়ে কান্না করতো।
মিসেস চৌধুরী : গলা ফাটিয়ে কান্না করতো!
দাদিমা : তবে এ ছিল কেবল শুরু। এরপর দেখা গেল সে তার বাবা ছাড়া কিছুই বোঝে না।
মিসেস চৌধুরী : বাবা ছাড়া কিছুই বুঝতো না! তাহলে তো আত্মসম্মানবোধ আছে এরকম কোন মা-ই এটা সহ্য করবে না।
দাদিমা : হ্যাঁ, সে তো কথায় কথায় গায়ে হাত তুলতো। তারপর ছেলেটি সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ডেকে মরে গেলেও উত্তর দিতো না।
মিসেস চৌধুরী : উফ, কি বেয়াদব!
দাদিমা : হ্যাঁ, তারাও তাকে এটাই বলতো। কিন্তু তারপর ছেলেটা বাইরে গিয়ে বাজে ছেলেদের সাথে মেশা শুরু করলো।
মিসেস চৌধুরী : বাজে ছেলে? তাহলে তো তাকে ঘরে আটকে রাখতে হবে।
দাদিমা : হ্যাঁ, (সম্মতির সুরে) তারা ঠিক তাই করেছিলো। তারা ছেলেটিকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতো না।
মিসেস চৌধুরী : একদম ঠিক করেছিলো।
দাদিমা : তারাও তাই ভেবেছিলো। কিন্তু একদিন ছেলেটা লুকিয়ে বাড়ির বাইরে যেতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। তারপর তারা তাকে ঘরে আটকে রাখে।
মিসেস চৌধুরী : রাখাটাই স্বাভাবিক।
দাদিমা : কিন্তু ছেলেটা ভীষণ একরোখা ছিলো। একদিন সে তার মাকেই গালি দিয়েছিলো।
মিসেস চৌধুরী : তাহলে তো ওর জিভ কেটে ফেলা উচিত।
দাদিমা : হ্যাঁ, তারা তাই-ই করেছিলো। তারপর থেকে যত দিন যেতে থাকে ছেলেটার বাজে স্বভাবগুলো সবার সামনে আসতে থাকে। পড়াশোনা করতো না, দুনিয়ার সব বাজে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াতো, এমনকি নেশাও করতো।
মিসেস চৌধুরী : কি সাংঘাতিক!
দাদিমা : হ্যাঁ, এত কিছু দেখার পর তারা এ ছেলেকে নিয়ে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলো, বুঝতে পারছো?
মিসেস চৌধুরী : হুম বুঝলাম। তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় নি?
দাদিমা : পদক্ষেপ? হ্যাঁ নিয়েছিলো। অনেক বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলো। তারপর ছেলেটাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। কিন্তু তারা এতে সন্তুষ্ট না। তারা ওর পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করেছে কিন্তু আশানুরূপ কোন ফল পায় নি। তাই তারা সেই ভদ্রমহিলাকে আবার ডেকে পাঠায়, যাতে তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিতে পারে।
মিসেস চৌধুরী : তাই বুঝি!
[পেছনের ঘর থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসবে…]
দাদিমা : আচ্ছা, তুমি কি আপেল খাবে?
বাবুর আব্বু : (নেপথ্যে) বাবুর আম্মু, দাদিমার টিভিটা তো পাচ্ছি না। এমনকি বিড়ালটাও নেই।
বাবুর আম্মু : (নেপথ্যে) আর এদিকে তো আমি পানি খুঁজে পাচ্ছি না।
দাদিমা : হা হা হা, বলেছিলাম না? সবকিছু লুকিয়ে রেখেছি!
মিসেস চৌধুরী : আপনি কি তাহলে সত্যিই সবকিছু লুকিয়ে রেখেছেন?
দাদিমা : তো? আমি কি মিথ্যা বলি!
বাবুর আম্মু : দাদিমা, দেখেছো কি হয়েছে? বাবুর আব্বু না তোমার টিভি খুঁজে পাচ্ছে, না তোমার বিড়ালটাকেও খুঁজে পাচ্ছে না। এমনকি তোমার রুমই খুঁজে পাচ্ছে না।
দাদিমা : বললাম না? আমি সব লুকিয়ে রেখেছি।
বাবুর আম্মু : যত্তসব…দাঁড়াও তোমাকে একবার হাতে পাই, দেখাচ্ছি মজা! তুমি আসলেই একটা উটকো ঝামেলা।
দাদিমা : হাতে পাবে কী করে? আমি একটু পরেই চলে যাবো।
বাবুর আম্মু : বাবুর আব্বু তো অনেক দিন আগে থেকেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি দিতে দেইনি। তবে শুনে রাখো, এসব আর বেশিদিন চলবে না। এসব আর আমার ভালো লাগছে না। এবার বাবুর আব্বু যা বলবে তাই হবে। তারপর দেখবা কী হয়! বাবুর আব্বু তোমাকে গাড়িতে করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবে।
দাদিমা : আমি তো নিজেই চলে যাবো।
বাবুর আম্মু : হ্যাঁ, তাই যেয়ো। (মিসেস চৌধুরী কে) চলুন রান্নাঘর থেকে পানি খেয়ে আসবেন। দাদিমার সাথে এত কিসের কথা আপনার?
মিসেস চৌধুরী : এখানে আবার দাদিমাকে টানছেন কেন? আর আপনি এভাবে আমার সাথে কথা বলতে পারেন না।
বাবুর আম্মু : আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন এটা আমার বাড়ি আর আপনি এখানে অতিথি।
দাদিমা : এটা একটা ফ্ল্যাট!
বাবুর আম্মু : আপনি তো একজন কর্মজীবী নারী। যদি আপনি রান্নাঘরে আসেন তবে হয়তো আমি আপনাকে গ্লাস এবং পানি দেখিয়ে দিতে পারি। তারপর কী করতে হবে সেটা আশা করি আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।
[বাবুর আম্মুর প্রস্থান]
মিসেস চৌধুরী : ( কিছুক্ষণ চিন্তা করে) উনি হয়তো ঠিকই বলেছেন!
দাদিমা : বিষয়টা হচ্ছে এমন যে, এ বাড়ির মানুষ মেহমানদারকে দিয়েই বাড়ির কাজ করিয়ে নেয়।
মিসেস চৌধুরী : আমার মনে হয় আপনিও ঠিক বলছেন। দাদিমা, আপনার সাথে কথা বলে বেশ ভালোই লাগলো।
দাদিমা : আমারও ভালো লাগলো। আচ্ছা তোমাকে আমি যা বললাম তা যেন আবার বাবুর আব্বু, বাবুর আম্মুকে বলো না।
মিসেস চৌধুরী : না না।এসব কথা কি কাউকে বলা যায়? এ নিয়ে আমি একটা শব্দও করবো না।
দাদিমা : কী জানি আমার কথা তুমি আদৌ বুঝতে পেরেছো কিনা…
মিসেস চৌধুরী : আমিও জানি না। তবে বুঝে যাবো আশা করি। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে। এখানে আমার চরিত্রটা কোথায়! আমি তো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করি। আর, যতদূর মনে পড়ছে…আমি এক দম্পতিকে একটি বাচ্চাও দিয়েছিলাম। উম…বাবুর আব্বু, বাবুর আম্মুই হয়তো আমার কাছে এসেছিলেন। এটা প্রায় বিশ বছর আগের কথা…কিন্তু তাদের চেহারাটা আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে…তবে তারা আমার কাছে একটা বাচ্চা কিনতে এসেছিলেন। উফ…কী বিপদ! কিছুই মনে পড়ছে না। আমাকে একটু ভাবতে হবে। যাই হোক, আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ যে আমাকে আপনি সাহায্য করতে চেয়েছেন । আচ্ছা, আমি তাহলে যাই একটু পানি খেয়ে আসি। আপনি তো এখানেই আছেন, তাই না?
দাদিমা : হয়তো…আমার তো আর আগের মতো গায়ের জোর নেই।
মিসেস চৌধুরী : আচ্ছা। তাহলে তো এখন আর বিদায় নেওয়ার প্রোয়োজন নেই।
দাদিমা : না, নেই।
[মিসেস চৌধুরীর প্রস্থান]
মানুষ বৃদ্ধদের বিদায় জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। তারা মনে করে বৃদ্ধরা এতে ভয় পায়।কিন্তু যদি তারা জানতো তাদের এসব হাই, হ্যালো শুনতে আমাদের কতটা অদ্ভুৎ লাগে… তবে তারা কখনোই এসব বলতো না।
[কলিং বেল বাজার শব্দ পাওয়া যায় ]
দরজা খোলা আছে।
[যুবকের প্রবেশ]
দাদিমা : ( যুবককে ভালো করে দেখে) দেখো, দেখো, কী অপূর্ব দৃশ্য!
যুবক : হ্যালো…শুনছেন?
দাদিমা : ও মা…তুমিই কি তাহলে সেই গাড়ির ড্রাইভার?
যুবক : আমি…কী?
দাদিমা : গাড়ির ড্রাইভার! গাড়ির ড্রাইভার! তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে এসেছো?
যুবক : আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছিনা।
দাদিমা : ওহ…আচ্ছা!…তুমি কিন্তু বেশ দেখতে!
যুবক : হুম!
দাদিমা : আমি কিন্তু বলেছি তুমি দেখতে বেশ!
যুবক : ওহ…ধন্যবাদ।
দাদিমা : মনে হচ্ছে এটা শুনে তুমি খুশি হওনি।
যুবক : আসলে, এটা আমি প্রায়ই শুনি।
দাদিমা : আচ্ছা… আচ্ছা! আমার যদি বয়স থাকতো , তোমার জন্য দিওয়ানা হয়ে যেতাম।
যুবক : হ্যাঁ…আমিও অনুমান করতে পারছি।
দাদিমা : তোমার স্বাস্থ্যটাও তো বেশ ভালো!
যুবক : হু…আমি সময় মতোই খাওয়া দাওয়া করি।
দাদিমা : বাহ…খুব ভালো অভ্যাস।
যুবক : আমি ছোটবেলা থেকেই নাদুস নুদুস ছিলাম। তারপর এখন তো আবার জিমে যাই।
দাদিমা : হুম, তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তুমি কিন্তু চাইলেই নাটক সিনেমায় যেতে পারো।
যুবক : সেটা আমি জানি।
দাদিমা : হ্যাঁ, ঠিক ঐ সোনালী পর্দায়। কিন্তু আমার মনে হয় এটাও তুমি আগে শুনেছো।
যুবক : হ্যাঁ, শুনেছি তো।
দাদিমা : তোমার কিন্তু সত্যিই নাটক সিনেমায় যাওয়া উচিত।
যুবক : আসলে আমিও বহুবার চেষ্টা করেছি। দুই একটা নাটকে ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেছি। কিন্তু সেরকম সফলতা পাইনি। অবশ্য আমি এসব নিয়ে বেশি ভাবি না। আমার জীবনের তো মাত্র শুরু…
দাদিমা : হুম, ঠিকই বলেছো। আর তুমি দেখতেও তো অনেক সুন্দর।
যুবক : হ্যাঁ…সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, লম্বা, চওড়া, উজ্জ্বল বর্ণ, লম্বা নাক, শেলীর মতো চোখ, নির্মল হাসি… সুদর্শন।
দাদিমা : তুমি তো দেখছি নিজের বিষয়ে ভালোই জানো! তুমিই তো আসল ‘সন্তুষ্টি’। বাকিরা তো জানেই না তারা কী বলছে, কিসের পিছনে ছুটছে! আর তুমি…তুমি সত্যিই ‘সন্তুষ্টি’।
যুবক : ধন্যবাদ।
বাবুর আম্মু : (নেপথ্যে) কে…কে এসেছে?
দাদিমা : (চিৎকার করে) ‘ সন্তুষ্টি’।
বাবুর আম্মু : (নেপথ্যে) কার কথা বললে?
দাদিমা : (চিৎকার করে) আরে…সন্তুষ্টি…সন্তুষ্টি।
বাবুর আব্বু : (নেপথ্যে) কে এসেছে, বাবুর আম্মু?
বাবুর আম্মু : (নেপথ্যে) আরে কেউ না। ওদিকে কান দিয়ো না তো। তুমি দেখো দাদিমার রুম খুঁজে পাও কিনা।
বাবুর আব্বু : (নেপথ্যে) আমি তো এখন মিসেস চৌধুরীকেও খুঁজে পাচ্ছি না।
যুবক : কারা কথা বলছে?
দাদিমা : ওরাও এ বাড়ির লোক। ওদের কথা ছাড়ো…তোমার কথা বলো।
যুবক : আচ্ছা, ঠিক আছে।
দাদিমা : এখন বলো…তুমি যদি গাড়ির ড্রাইভার না হও তাহলে এখানে তুমি কী করছো?
যুবক : আসলে আমি কাজের সন্ধানে এসেছি।
দাদিমা : সত্যি? কী ধরনের কাজ খুঁজছো?
যুবক : যেকোনো একটা কাজ হলেই হলো। আমি টাকার বিনিময়ে সব করতে পারবো।
দাদিমা : তাই নাকি? আচ্ছা দেখি…তোমাকে কী কাজ দেওয়া যায়!
যুবক : একটু দেখেন…এত বড় বাড়িতে তো কাজের অভাব হবার কথা না।
দাদিমা : কোথায় এত বড় বাড়ি দেখলে তুমি? আমার কাছে তো ছোটই মনে হয়। অবশ্য তুমি আমার থেকে ভালো বুঝতে পারো।
যুবক : আমার তো এমনই মনে হলো।
দাদিমা : আমার মনে হয়, তোমাকে দেওয়ার মতো বেশ কিছু কাজ আছে…উহ…ওখানেই থাকো…কাছে আসবে না…
যুবক : দুঃখিত।
দাদিমা : অবশ্য আসলেও আমি কিছু মনে করবো না! কিন্তু, দেখতে ভালো দেখায় না।
যুবক : হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।
দাদিমা : এখন ওখানেই দাঁড়াও। আমাকে দেখতে দাও। এই বাড়িতে অনেক কিছুই করার আছে। এরা অনেক অলস। হয়তো তুমি এদের সাহায্য করতে পারবে।
যুবক : টাকা দিলেই করতে পারবো। আচ্ছা, আপনার কাছে টাকা আছে?
দাদিমা : টাকা? আশেপাশে অনেক টাকাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না যে এত টাকা দিয়ে তুমি কী করবে।
যুবক : তাই?
দাদিমা : হ্যাঁ। আমার কাছেও কিন্তু টাকা আছে।
যুবক : আছে আপনার কাছে?
দাদিমা : অবশ্যই আছে। বৃদ্ধ মানুষদের কাছে যে টাকা থাকতে পারে তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। তোমাকে কানে কানে বলি…বেশি কাছে এসো না আবার…
যুবক : ( একটু পেছনে সরে) ওহ…আমি দুঃখিত।
দাদিমা : আচ্ছা…ব্যাপার না। যাইহোক, তুমি কখনো রান্নার প্রতিযোগীতার কথা শুনেছে যেখানে বৃদ্ধ মানুষেরা অংশগ্রহণ করে?
যুবক : আমি ঠিক বলতে পারছি না।
দাদিমা : এত বেশি কাছে এসো না তো! ভালো, দূরে দূরেই থাকো। তোমার শোনা না শোনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো আমি এটা কাউকে জানাতে চাচ্ছি না। এ বাড়ির লোকেরা মনে করে গত আট বছর আমি বাড়ির বাইরে যাই না। কিন্তু আমি এ বছরই রান্নার প্রতিযোগীতায় প্রথম পুরষ্কার পেয়েছি। আমার নাম তো খবরের কাগজেও ছাপা হয়েছিলো। কিন্তু সেটা আমার আসল নাম ছিলো না। আমার নাম ছিলো গুনি ময়রা।
যুবক : তাই নাকি?
দাদিমা : হ্যাঁ, আমার রান্না করা খাবারের নাম ছিলো “মিষ্টি দাদুর মিষ্টি পায়েস”।
যুবক : বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো!
দাদিমা : এটা তেমন কষ্টেরও ছিলো না। তুমি জেনে অবাক হবে যে আমি পায়েসটা রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর সবার চোখের আড়ালে সেটাই পরিবেশন করেছিলাম। বিচারকদের আমার ঐ পায়েসটাই বেশি পছন্দ হয়েছিলো।
যুবক : বাহ, আপনি তো বেশ চালাক!
দাদিমা : হুম…শিয়াল পন্ডিত!
যুবক : আপনি কী সত্যিই এটা করেছিলেন? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!
দাদিমা : বিশ্বাস কা না করা তোমার ব্যাপার। তবে মিষ্টি দাদুর মিষ্টি পায়েস আমাকে দশ লক্ষ টাকা জিতিয়ে দিয়েছিলো।
যুবক : দশ…লক্ষ… টাকা…!
দাদিমা : আমি জানতাম তুমি অবাক হবে।
যুবক : অবাক হবারই কথা।
দাদিমা : কিন্তু তোমাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে…
যুবক : হুম? কি বললেন?
দাদিমা : আমি বললাম তোমাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে।
যুবক : আপনি হয়তো আমাকে টিভিতে দেখেছেন।
দাদিমা : না, না…টিভিতে না। তুমি দেখতে আমার এক আত্মীয়ের মতো।
যুবক : ওহ! হতেই পারে!
দাদিমা : না, সত্যিই তুমি আমার এক আত্নীয়ের মতো দেখতে। আচ্ছা, যদি তুমি কিছু মনে না করো…তুমি কেন বললে যে তুমি টাকার জন্য সবই করতে পারো?
যুবক : না না, এটা তো আমি কথার লথা বলেছি। সত্যি বলতে আমি কিছুই পারি ন। আমার এই চেহারা ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা নেই। আসলে আমি অসম্পূর্ণ।
দাদিমা : অসম্পূর্ণ? না, তুমি তো দেখতে ঠিকঠাকই আছো।
যুবক : আচ্ছা, তাহলে আপানকে খুলে বলি। আপনার বয়স হয়েছে, আপনি তো এ কথা আর কাউকে বলতে যাচ্ছেন না। এগুলো আমি আসলে কাউকে বলতে চাই না কারণ তারা এগুলো নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে।
দাদিমা : আাহা রে বেচারা! তুমি নিশ্চিন্তে আমাকে বলতে পারো।
যুবক : শুনুন তাহলে। জন্মের পরপরই আমার মা মারা যায়, আর বাবা কে তাও জানি না। আমার ধারণা, আমার মা ও জানতো না। তবে আমি একা ছিলাম না। আমার সাথে আমার যমজ ভাই ছিলো।
দাদিমা : ও মা, তাই নাকি!
যুবক : হ্যাঁ। আমরা দেখতে একই রকম ছিলাম। আমাদের দেহ আলাদা হলেও আত্মা ছিলো এক। আমরা একে অন্যের দুঃখকষ্ট বুঝতে পারতাম। এমনকি আমাদের একই সাথে ক্ষুধা লাগতো আর একই সাথে কান্না পেতো। আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?
দাদিমা : আমি বুঝতে পারছি। এটুকু বোঝার মতো বয়স হয়েছে আমার।
যুবক : আমিও তাই মনে করি। কিন্তু আমি আর আমার যমজ ভাই অনেক ছোটবেলাতেই আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। তবে একটা প্রাণ কিভাবে আলাদা করবে? তবুও তারা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো। ছুড়ে ফেলেছিলো দুই মেরুর দুই প্রান্তে। আমি জানি না আমার ভাইয়ের কী হয়েছে। সে আমার হৃদয়ের অর্ধেক অংশ। যতই দিন যেতে থাকে ততই মনে হয় আমি কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি। আমি ঠিক আপনাকে বোঝাতে পারবো না। মনের মধ্যে গভীর কষ্ট জমাট বেধে আসতো…নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো…ব্যাথা…যন্ত্রণা… কি ভাবে যে বলি? হ্যাঁ, কিছুটা এমন যে একসময় আমার গায়ে প্রচন্ড ব্যাথা হতো; কারো সাথে কথা ব্লতে ইচ্ছা করতো না। এক সময় কথা বলার শক্তিই হারিয়ে ফেলি; মনে হতো কেউ যেনো আমার জিহ্বা কেটে দিয়েছে। মাঝে মাঝে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো। মনে হতো যে, কেউ আমাকে বদ্ধ ঘরে আটকে রেখেছে। নিজেকে এই অদ্ভুত অনুভূতি থেকে অনেকবার মুক্ত করতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। সবসময় মনে হতো আমি যেন একটা ডানা কাটা পাখির মতো খাঁচার মধ্যে ছটফট করছি। আপনি বিশ্বাস করেন আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে। আমি খারাপ ছেলেদের সাথে মিশেছি, অনেক খারাপ কাজও করেছি, এমনকি নেশার মধ্যে ও নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছি। কিন্তু কিছুতেই আামর মন শান্ত হতোনা। তারপর…একটা সময় আমি অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ি, কোনো কিছুই আমার ভেতর অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেনা।
দাদিমা : আাহারে…বেচারা! (দীর্ঘ বিরতি) আমি বুঝতে পারিনি আগে। আমি তোমাকে চিনতাম না। কিন্তু আমি একসময় একজনকে চিনতাম যে কিনা অনেকটা তোমার মতো…না…সে যেনো তুমিই ছিলে।
দাদিমা : শিশ্শ্শ্…
[যুবক দাদিমার কথা ভালো করে শোনার জন্য মাথা নিচু করবে]
কেউ একজন ছিলো যে কিনা দেখতে হুবহু তোমার মতো।…তা না হলে এটা আমার সাংঘাতিক ভুল হবে। তবে তোমার জন্য এখানে একটা কাজ আছে।
যুবক : আমাকে কি করতে হবে?
মিসেস চৌধুরী: (নেপথ্যে) কেউ কি কোথাও আছেন?
দাদিমা : (যুবককে) আচ্ছা শোনো, তোমাকে এখন ভেবে চিন্তে কাজ করতে হবে। তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে বলবো। এখন আমাকে আমার নিজের কাজে যেতে হবে।
যুবক : কিন্তু আমি….
[মিসেস চৌধুরীর প্রবেশ]
দাদিমা : (মিসেস চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে) কেন তোমার কাকে লাগবে?
মিসেস চৌধুরী : ওহ, দাদিমা…. আপনি তাহলে এখানে? আমি তো বাবুর আব্বু, বাবুর আম্মু কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিনা। (যুবকের দিকে তাকিয়ে) এটা কে?
দাদিমা : এটা? উম…এটা হচ্ছে…উম… গাড়ির ড্রাইভার। হ্যাঁ, ও ড্রাইভার।
মিসেস চৌধুরী : তাহলে এটা সত্যি যে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য গাড়ি ডেকেছে?
দাদিমা : (একটু ইতস্তত করে) আচ্ছা, তাহলে তো তুমি বুঝতেই পেরেছো।
মিসেস চৌধুরী : (যুবককে) তোমার সাহস তো কম না। তুমি এই অসহায় মহিলাকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যেতে এসেছো।
যুবক : (দাদিমার দিকে একবার তাকিয়ে, মিসেস চৌধুরীকে) আমাকে যা বলা হয়েছে আমি তাই করেছি।
মিসেস চৌধুরী : (একটু থেমে) ওহ্। (একটু চিন্তা করে) আমারও এ বিষয়ে মাথা ঘামানো ঠিক নয়।
দাদিমা : (যুবককে বক্সগুলো দেখিয়ে বললেন) সোনা, তুমি কি আমার জিনিসগুলো গাড়ি অব্দি পৌঁছে দেবে?
যুবক : (একটু ইতস্তত করে) হ্যাঁ, অবশ্যই দিবো।
[যুবক বক্সগুলো থেকে অর্ধেক নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকবে]
দাদিমা : কত চমৎকার, কমবয়সী একটা ড্রাইভার!
মিসেস চৌধুরী : (অবিশ্বাসে মাথা নাড়াতে নাড়াতে যুবকের প্রস্থান দেখতে দেখতে) হুম, কিছু পরিবর্তন ভালোর জন্যই হয়। আমার মনে আছে যখন আমি আমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাই, যে গাড়ির ড্রাইভার আমার মাকে নিতে এসেছিল, সে কোনদিক থেকেই এতটা চমৎকার ছিল না।
দাদিমা : ওহ, তুমিও কি তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েছিলে?
মিসেস চৌধুরী : (আনন্দের সাথে) হ্যাঁ, অবশ্যই। কেন আপনি পাঠাননি?
দাদিমা : (বিরক্তির সাথে) না না আমি পাঠাইনি। অন্তত আমার ওরকম কিছু মনে পড়ছে না। শোনো মেয়ে, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
মিসেস চৌধুরী : জ্বী, বলুন।
দাদিমা : তবে শোনো।
মিসেস চৌধুরী : জ্বী বলুন। শুনছি।
দাদিমা : মনোযোগ দিয়ে শোনো। বাবুর আব্বু ও বাবুর আম্মুকে নিয়ে তুমি যে সংকটে পড়েছো…..
মিসেস চৌধুরী : হ্যাঁ! কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তারা হুট করে কোথায় চলে গেলো।
দাদিমা : শোনো, তুমি বাবুর আব্বু ও বাবুর আম্মুকে নিয়ে যে সংকটে পড়েছো, আমি মনে হয় তোমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার একটা উপায় বলতে পারি।
[সামনের দরজা দিয়ে যুবকের পুনপ্রবেশ]
তুমি কি এবার আমার বাকি জিনিসগুলো নিয়ে যাবে, সোনা?
[বাকি বক্সগুলো নিয়ে যুবকের প্রস্থান]
(মিসেস চৌধুরীকে) ঠিক আছে, শোনো তাহলে…..
(দাদিমা মিসেস চৌধুরীর সাথে কানে কানে কথা বলতে লাগলেন)
মিসেস চৌধুরী : না না না…আমার মনে হয় না যে আমি এটা পারবো…আপনার কি সত্যিই মনে হয় আমি এটা পারবো? হ্যাঁ, কেন পারবো না!কত সুন্দর পরিকল্পনা…বাহ্ কি দুর্দান্ত পরিকল্পনা!
দাদিমা : হ্যাঁ, আমি জানি এটা অসাধারণ।
মিসেস চৌধুরী : এই বয়সেও আপনি….!
দাদিমা : হা…হা…হা!
মিসেস চৌধুরী : যাইহোক, এটা একটা চমৎকার পরিকল্পনা। আমি এক্ষুনি বাবুর আব্বু ও বাবুর আম্মুকে খুঁজে আনছি।
দাদিমা : ঠিক আছে। যাও তুমি।
মিসেস চৌধুরী : বেশ, আমি আপনাকে এবার বিদায় জানাচ্ছি। আমি জানি না আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাবো। (তিনি বাসার ভেতরে যেতে থাকবেন…)
দাদিমা : ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার ওটা বলো।
মিসেস চৌধুরী : জ্বী, কী বলবো?
দাদিমা : বলো, বিদায়।
মিসেস চৌধুরী : ওহ্, বিদায়।
[মিসেস চৌধুরীর প্রস্থান]
বাবুর আব্বু…. বাবুর আম্মু… আপনারা কোথায়?
দাদিমা : বিদায়। (চারদিকে তাকিয়ে) এই ঘর…এই সংসার…কত স্মৃতি…(দীর্ঘশ্বাস)
[পুনরায় যুবকের প্রবেশ]
তুমি এসে গেছো?
যুবক : সবগুলো বক্স বাইরে রেখে এসেছি।
দাদিমা : (একটু দুঃখিতভাবে) আমি জানিনা কেনই বা আমি এগুলো আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। এগুলোর ভেতরে তো তেমন কিছুই নেই…কিছু পুরোনো চিঠি…কিছু অনুশোচনা…ভাঙ্গা চশমা…টেলিভিশন…আমার অন্ধ বিড়ালটা…ছিয়াশি বছরের স্মৃতি…কিছু শব্দ…কিছু ছবি, যদিও সেগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে এখন…আর…! (দীর্ঘশ্বাস) বোঝই তো…যেগুলো মানুষ আঁকড়ে বাঁচে।
যুবক : আমি কি আপনার জন্য গাড়ি বা অন্য কিছু আনব?
দাদিমা : না সোনা, ওসবের আর দরকার নেই। তুমি যা করেছ এই যথেষ্ট। বাকিটা আমিই করে নিতে পারবো।
যুবক : তাহলে আমি এবার কি করবো?
দাদিমা : ওহ্…. তুমি এখানেই থাকো, সোনা। ধীরে ধীরে সবকিছু তোমার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।
যুবক : ঠিক আছে।
দাদিমা : (চারদিকে আরেকবার দেখে) আচ্ছা, ঠিক আছে।
যুবক : চলুন আপনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেই।
দাদিমা : তবেতো বেশ ভালোই হয়, সোনা।
[ধীরে ধীরে তারা সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে]
[মিসেস চৌধুরীর প্রবেশ। বাবুর আব্বু ও বাবুর আম্মু তার পেছনে]
মিসেস চৌধুরী :…আমি আপনাদের অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে পুরো ব্যাপারটাই ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
বাবুর আম্মু : এটা শুনে আমরাও অত্যন্ত আনন্দিত। আমাদের ভয় হচ্ছিল যে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে, তাছাড়াতো আপনার এত দেরি হবার কথা না।
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, আমরা এখন নিশ্চিন্ত।
মিসেস চৌধুরী : হুম, এটাইতো কর্মজীবী মহিলাদের কাজ।
বাবুর আম্মু : কিন্তু, দাদিমা কোথায়? দাদিমা তো এখানে নেই। দাদিমা কোথায়? আর দেখো…! বক্সগুলোও তো নেই! দাদিমাও নেই! সে চলে গিয়েছে এবং নিশ্চয়ই কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে। বাবুর আব্বু…! (কান্না করতে করতে বসে পড়বে।)
মিসেস চৌধুরী : তাকে তো ড্রাইভার নিতে এসেছিল।
বাবুর আম্মু : (আঁতকে উঠে) কী….?
মিসেস চৌধুরী : ড্রাইভার, গাড়ির ড্রাইভার এসেছিল।
[হঠাৎ আলো কিছুটা ক্ষীণ হয়ে যাবে]
বাবুর আম্মু : (মাথা ঝাঁকিয়ে) না, এটা অসম্ভব।
মিসেস চৌধুরী : কেন? আমি তাকে নিজের চোখে যেতে দেখেছি।
বাবুর আম্মু : (কাঁদো কাঁদো কন্ঠে) না…না…এটা হতে পারে না। না…এটা অসম্ভব। কোন গাড়ির ড্রাইভারের আসার কথা ছিল না। আমরা তো বানিয়ে বলেছিলাম। দাদিমা! দাদিমা!
বাবুর আব্বু : (বাবুর আম্মুর দিকে এগিয়ে এসে) শান্ত হও…শান্ত হও!
বাবুর আম্মু : ওহ্…বাবুর আব্বু…দাদিমা কোথায়!
বাবুর আব্বু : শান্ত হও…শান্ত হও!
[বাবুর আব্বু যখন বাবুর আম্মুকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, তখন দাদিমা বাইরে থেকে তাকে বাবুর আব্বু ও বাবুর আম্মু দেখতে পাবে না। তবে বাকিরা দেখতে পাবে]
দাদিমা : (দর্শকদের সামনে মুখে হাত দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করবে, তারপর…) আমি এগুলো দেখতে চাই।
[দাদিমা মিসেস চৌধুরীর দিকে অগ্রসর হন। মিসেস চৌধুরী মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে নিঃশব্দে দরজার কাছে যাবেন এবং দরজা খুলবেন। দরজার ওপাশে যুবককে দেখা যাবে। যুবক প্রবেশ করতে না করতেই কক্ষ আবার আলোকিত হয়ে উঠবে]
মিসেস চৌধুরী : দেখুন কে এসেছে…
বাবুর আম্মু : (কাঁদো কাঁদো কন্ঠে) কে? কে এসেছে?
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ, কে এসেছে?
মিসেস চৌধুরী : কেন, আপনাদের আমি বলেছিলাম না যে আপনাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে….
বাবুর আম্মু : সার… প্রাইজ?
বাবুর আব্বু : (বাবুর আম্মুকে উৎফুল্ল করার জন্য) তেমার মনে আছে বাবুর আম্মু, ওনাকে আমরা… আহ্… কি যেন তার নাম… যাকে আসতে বলেছিলাম?
মিসেস চৌধুরী : মিসেস চৌধুরী, যদি আপনি ভুলে গিয়ে থাকেন।
বাবুর আব্বু : হ্যাঁ…হ্যাঁ…তাই তো। বাবুর আম্মু…মনে পড়েছে তোমার? ঐ যে বাচ্চাটা…সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায়?
বাবুর আম্মু : (তার চেহারায় আনন্দের রেখা ফুটে উঠল) হ্যাঁ…হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে! কি চমৎকার!
মিসেস চৌধুরী : (যুবককে) ইনি হচ্ছেন বাবুর আম্মু।
যুবক : হ্যালো, ম্যাডাম।
মিসেস চৌধুরী : আর ইনি হচ্ছেন বাবুর আব্বু।
যুবক : হ্যালো, স্যার।
বাবুর আম্মু : (যুবকের চারপাশে ঘুরে এবং হাতে খোঁচা দিয়ে দেখে) এইতো ঠিক আছে। এইবার তো ঠিকই আছে। বাবুর আব্বু! এসো, এসো, দেখ তো সব ঠিক আছে কিনা!
বাবুর আব্বু : আমি…আমি এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি, বাবুর আম্মু। দেখে তো সব ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।
বাবুর আম্মু : আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো!
মিসেস চৌধুরী : আরে…এসব নিয়ে একদম ভাববেন না। আমি ঠিক সময়মতো আপনাকে রশিদটা পাঠিয়ে দিব।
বাবুর আম্মু : এটাতো তো আনন্দ করার সময়। চলো সবাই মিষ্টিমুখ করি।
মিসেস চৌধুরী : তাহলে তো দারুন হয়।
বাবুর আম্মু : (বাবুর আব্বুকে) রান্নাঘরে কিছু মিষ্টি আছে নিয়ে এসো তো….
যুবক : আমি আনছি।
বাবুর আম্মু : তুমি আনবে? বাহ্… দারুণ তো! এই যে রান্নাঘরটা এই দিকে।
[যুবকের প্রস্থান]
ছেলেটা চমৎকার। একেবারে অসাধারণ। আগেরটার থেকে অনেক ভালো।
মিসেস চৌধুরী : আপনাকে সন্তুষ্ট দেখে আমি আনন্দিত। আমি আরও আনন্দিত যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
বাবুর আম্মু : এখন অন্তত আমরা জানতে পারলাম যে আপনাকে কেন ডেকেছিলাম। এই বিষয়টা পরিস্কার হওয়াতে আমরা সত্যিই আনন্দিত। কিন্তু, ছেলেটার নাম কি?
মিসেস চৌধুরী : আপনাদের যা ইচ্ছা তাই বলে ডাকতে পারেন। ও তো এখন আপনাদেরই। চাইলে, আগেরটাকে যে নামে ডাকতেন, এটাকেও সেই নামে ডাকতে পারেন।
বাবুর আম্মু : বাবুর আব্বু….আমরা অগেরটাকে কি নামে ডাকতাম?
বাবুর আব্বু : (মনে করার চেষ্টা করে) কি যেন….!
[একটি ট্রেতে কিছু মিষ্টি আর পাঁচ গ্লাস জুস নিয়ে যুবকের প্রবেশ]
যুবক : এই যে আমি চলে এসেছি।
মিসেস চৌধুরী : বাহ্ বেশ।
বাবুর আম্মু : (ট্রের কাছে গিয়ে) পাঁচটা গ্লাস? পাঁচটা গ্লাস এনেছ কেন? আমরা তো মাত্র চারজন।
যুবক : (দাদিমার দিকে তাকাবে। দাদিমা ইশারায় বুঝিয়ে দিবে যে তিনি এখানে নেই) ওহ্…আমি দুঃখিত।
বাবুর আম্মু : তুমি এখন বড়লোকের ছেলে। তোমাকে এসব শিখতে হবে।
যুবক : আচ্ছা, আমি শিখে নেব।
বাবুর আম্মু : এখন সবাই একটা করে গ্লাস নাও।
[সবাই গ্লাস নেবে]
কে বলেছে আজকাল সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না?
মিসেস চৌধুরী : কি অসাধারণ জুস!
বাবুর আম্মু : ঠিক বলেছেন! (যুবককে) তুমি বিশ্বাস করবে না যে, তোমাকে পেয়ে আমরা কতটা খুশি! শোনো, আগের ছেলেটার সাথে আমাদের যে সময় কেটেছে…সেগুলো তোমাকে পরে বলবো। (মিসেস চৌধুরীকে নির্দেশ করে) উনি চলে যাওয়ার পরে…উনিই এইসব সমস্যার জন্য দায়ী। আমি তোমাকে সবকিছুই বলবো। (যুবককে সামান্য সামনে সরিয়ে নিয়ে) হয়তো…হয়তো আজকেই বলবো।
যুবক: (একটু সরে গিয়ে) হ্যাঁ, ঠিক আছে।
বাবুর আব্বু: (হতভম্ব) তোমাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে…জানো তুমি? আমি ঠিক মনে করতে পারছি না….
দাদিমা : (দাদিমা মাঝপথে বাঁধা দিয়ে, দর্শকদের উদ্দেশ্য করে) ঠিক আছে… আমার মনে হয় সবকিছু এবার শেষ করার সময় এসে গেছে। আমি বলেছিল্যাম্ব যে, ভালোর জন্যই হোক আর খারাপের জন্যই হোক – এটা একটা কমেডি, এবং আমার মনে হয় আমাদের আর এগোনো ঠিক হবে না। না, অবশ্যই না। সুতরাং, যেটা যেমন আছে সেটা তেমনই থাক…যখন সবাই খুশি…যখন সবাই যা চায় তাই পেয়েছে অথবা তাই পেয়েছে যা সে মনে করে সে চায়। শুভ রাত্রি।
[যবনিকা পতন]
তারিখ: নভেম্বর ৭, ২০২৩



AstuteHorse