হুমায়ুন আজাদের গল্প
জুনাইদুল হক
হুমায়ুন আজাদ বহুমুখী এক প্রতিভার নাম। তিনি প্রচুর লিখেছেন, দারুণ লিখেছেন। কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার তিনি। বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, কিশোর-সাহিত্যিক ও কলাম লেখক হিসাবেও তিনি খ্যাত। মর্মান্তিক প্রয়াণের আগ পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত সৃষ্টিশীল একজন মানুষ ছিলেন। খ্যাতি পেয়েছিলেন প্রতিভাবান, প্রথাবিরোধী লেখক হিসাবে। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের। হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষক ছিলেন।
কবি, ঔপন্যাসিক ও কিশোর-সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ আমার অত্যন্ত প্রিয় হলেও আমি লিখছি গল্পকার হুমাযুন আজাদকে নিয়ে। কারণ তার গল্পগুলো সংখ্যায় মাত্র পাঁচ, আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে। পাঁচটি বিস্ময়কর ও মুগ্ধকর গল্পের সংকলন তার ‘যাদুকরের মৃত্যু’, যা ১৪০২ সালের ফাল্গুনে বা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশ করেছিলেন তাঁর অনেক বইয়ের প্রকাশক আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনি। সমর মজুমদার এঁকেছিলেন ৬০ পৃষ্ঠার চমৎকার বইটির প্রচ্ছদ।
‘অনবরত তুষারপাত’ ‘মহান শয়তান’ ‘যাদুকরের মৃত্যু’ ‘জঙ্গল, অথবা লাখ লাখ ছুরিকা’ এবং ‘আমার কুকুরগুলি’ – অপূর্ব পাঁচটি গল্পের সংকলন ‘যাদুকরের মৃত্যু’। শুধু গল্প বলা লেখকের উদ্দেশ্য ছিল না একেবারেই। প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খাঁটি শিল্প তিনি সৃষ্টি করেছেন। এমন গল্প বাংলাদেশে আগে কেউ পড়েনি। প্রতীক, রূপক আর চিত্রকল্পখচতি অপরূপ পাঁচটি গল্প। প্রতিষ্ঠাবান কবি তাঁর কাব্যময়, চমকপ্রদ গদ্যে তুলে এনেছেন জীবনের বাস্তবতা, জীবনের জটিলতা, জীবনের কবিতা। বাঙালি জীবনের রূঢ় বাস্তব নিয়ে, বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব দুঃখ-কষ্ট নিয়ে, দুর্গত বাংলাদেশকে নিয়ে মহৎ শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন প্রতিভার বরপুত্র হুমায়ুন আজাদ।
বলা হয়ে থাকে গল্পে শুধু গল্প থাকলে চলবে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকবে, প্রতীক-রূপক-চিত্রকল্পের সুন্দর ব্যবহার থাকবে, বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার থাকবে। সেই গল্পই সেরা গল্প যাতে গল্প থাকবে ও পরীক্ষা থাকবে, প্রতীক থাকবে, দুইয়ের সঠিক ভারসাম্য থাকবে। হুমায়ুন আজাদ সেই কর্মটি সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। গল্প একেবারে নেই, বা শুধুই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এমন গল্প তিনি লেখেননি। মাত্র পাঁচটি গল্প নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অত্যন্ত বিশিষ্ট এক গল্পকার।
বইয়ের নামগল্প ‘যাদুকরের মৃত্যু’ দিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করতে পারি। অপূর্ব একটি গল্প, এমন গল্প আগে বাংলাদেশে হয়তো লেখা হয়নি। গ্রন্থের এটি তৃতীয় গল্প। বারো পৃষ্ঠার গল্পটি মহৎ গল্প হয়ে উঠেছে। প্রতীক-রূপক- চিত্রকল্পখচতি এক অসাধারণ গল্প। কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছেন এক মহৎ যাদুকর, যাকে অনেকেই দেশের স্থপতি ভাববেন, বাঙালি ও বাংলাদেশের মানুষের সেরা রূপকার ভাবেন। হুমায়ুন আজাদের গদ্য কাব্যময় এবং সুখপাঠ্য, অত্যন্ত বেগবান ও আকষর্ণীয়। বাস্তব আশ্রয় করে রচনা করেন তিনি মহৎ শিল্পকলা। গল্পটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে তার গুণবিচার করা যেতে পারে:
‘আমাদের ছোট, সুন্দর দেশটি একশো নব্বই বছর ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল, চব্বিশ বছর ছিল পাকিস্তানি উপনিবেশ। যাদুকরের সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানি উপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে দেশকে স্বাধীন করার, মুক্ত করার। কেমন ছিল আমাদের দেশ উপনিবেশ হিসেবে? আমাদের একমুঠো দেশটির মানচিত্রের দিকে তাকালে সেটিকে দোমড়ানো বুটের মতো মনে হয়। আগে এমন মনে হতো না। যে দিন বর্বররা এলো, দখল করলো আমাদের দেশটি, সেদিন থেকেই এমন মনে হতে থাকে।’
দোমড়ানো বুট! দেশের মানচিত্রের প্রতীক। কী অপূর্ব তুলনা। কত কিছু বলে প্রতীক। দেশের দুর্দশা, অত্যাচারী সামরিক শাসক হত্যা-নির্যাতন, সবকিছু এতে এসে হাজির হয়। লেখকের বুদ্ধিমত্তার প্রসংশা করতেই হয়।
যে নদী আগে কয়েক ক্রোশ চওড়া ছিলো, বর্বররা আসার পর, চর পড়ে সে-নদী খালের মতো রোগা হয়ে উঠলো আর আমাদরে ঘরবাড়িগুলোকে যেন অসুখে ধরলো। ‘…বর্বররা আসার পর খুশি জিনিশটিই অচেনা হয়ে গেলো।’ এমন অবস্থায় যাদুকরের আগমন ঘটে। কি পরিবর্তন এলো? ‘যাদুকর আমাদের ফিরিয়ে দেয় সেই শক্তি; মুগ্ধ হওয়ার রহস্য অনুভব করার অলৌকিক শক্তি।’ কেমন এই যাদুকর? ‘জোয়ারের সাথেই তার তুলনা করা চলে। একটা জোয়ার আসে আমাদের বিমর্ষ জীবনে। সেই যাদুকর আমাদের গরিব পাড়াগাঁয়ে, বিষণ্ণ শহরে, গ্রামে-গঞ্জে মাঠে, বিষণ্ণ বনে বনে যাদু দেখাতে লাগলো।’ ‘বহু দিন পর, বর্বররা আসার পর, সেই প্রথম আবার জীবন ফিরে এসেছে আমাদের জীবনে।’
‘বর্ববরা আসার পর আমরা কোন স্বপ্ন দেখিনি; অজানালোক থেকে যাদুকর আসার পর আমরা আবার স্বপ্ন দেখতে থাকি।’ স্বপ্ন ফিরে আসে, গান ফিরে আসে, স্মৃতি ফিরে আসে। মানুষ বুঝল, ‘তাদের হাতে শেকল, পায়ে শেকল। ‘যাদুকর শেখালেন শেকল-ভাঙার গান। বাংলাদেশ জুড়ে বাজতে লাগলো শৃঙ্খল চুরমার হওয়ার শব্দ।’ ‘এমন মধুর, মহান, শিল্পরহস্যময় ধ্বনি আগে আমরা কখনো শুনি নি।’ ‘বর্বররা আসার পর এমন নির্ভার আমরা কখনও বোধ করিনি।’ কিন্তু এমন মুক্তি, এমন নির্ভার স্বাধীনতা আমাদের ভাগ্যে বেশিদিন থাকলো না। দেশি বিদেশি নানা চক্রান্তে আমরা হারালাম সেই শেকলমুক্ত নির্ভরতা। পরদিনই যাদুকরের লাশ পাওয়া গেল শহরের চৌরাস্তায়। বর্বরদের একটি বিশাল ছুরিকা আমূল গাঁথা যাদুকরের হৃৎপিণ্ডে।’ শস্যের কণায় আপর পচন ধরলো।’ ‘আমাদের ছোটো দেশটিকে আবার মনে হতে লাগলো দোমড়ানো বুটের মতো। স্বপ্ন দেখা ভুলে গেলাম আমরা।’ ফিরে এলো প্রাক-স্বাধীন অবস্থা।
অপরূপ এক গল্প ‘যাদুকরের মৃত্যু’। এর তীক্ষ্ণ বর্ণনা, প্রতীক-চিত্রকল্প আমূল গেঁথে যায় আমাদের মনে। আবহমান বাংলার ইতিহাস পাঠ করি আমরা, অতীত থেকে ফিরে আসি নিকট অতীতে। বাংলার সব রূপ ফুটে ওঠে চোখের সামনে; বাংলার সব দুর্দশা আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। সার্থক শিল্পসৃষ্টি আমাদের মুগ্ধ করে, স্তব্ধ করে রাখে।
রূঢ় বাস্তব, যান্ত্রিক জীবন আমাদের উপহার দেয় শীতলতা। বেঁচে থাকার ইঁদুর দৌড়ে অংশ নিয়ে শীতল হয়ে যাই আমরা, হারাই প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ-বাতসল্য-স্মৃতি-স্বপ্নে সুন্দর জগৎ। তুষার আমাদের সেই উষ্ণ, সুন্দর জীবন হারানোরই প্রতীক, সর্বগ্রমী সেই শীতলতার প্রতীক। মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া সদ্য বিবাহিত দম্পতির শরীর, তাদের গাড়ি, তাদের চারপাশ তুষারে আচ্ছাদিত হয়ে যায়। প্রতীকের কি সার্থক ব্যবহার। অপরূপ চিত্রকল্পের দুর্দান্ত সমাহার। গাড়ি নিয়ে রেহমান ও হাসিনা যাত্রা করার পর ফাল্গুনের উচ্চ, মধুর দিনে ‘উভয়ের শরীরে, মসৃণ সিল্ক ও সিল্কের থেকে মসৃণ ঝকঝকে ত্বক ভেদ করে শীত ও বরফকুচি ঢুকতে লাগলো।’ সার্থক এই গল্পটি গ্রন্থের প্রথম গল্প। আমাদের চমকে দেয়, নাড়া দেয়, আঘাত দেয়, আমাদের আত্মা শুদ্ধ করে। বাইরে বসন্ত অথচ গাড়ির ভেতরে গাড়ি যেন জীবনেরই বাহন – তাদের খুব শীত করছে। আমার শরীরে মধু, রেহমান এক আশ্চর্য মৌমাছি, বস্তু থেকে সে কেবল মধু আহরণ করে। হাসিনা ভাবে, কিন্তু চমকে উঠে দেখে গাড়িতে তুষার। তার চুল আর ঠোঁট থেকে একরাশ তুষার কুচি ঝরে পড়ে। তাদের শরীর উষ্ণ তবু খুব ঠান্ডা লাগছে। দিকে দিকে রোদ, কিন্তু গাড়ির ভেতরে তুষারপাত, তুষার ঝড় বেড়ে চলছে মুহূর্তে মুহূর্তে। জীবনেও তাই ঘটে, শীতলতা বয়সের অনুপাতে ঝড়ে। গল্পটি জুড়ে রয়েছে প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা। বাংলাদেশকে এই কবি-লেখক চেনেন তার হাতের তালুর মতো। ফুলটি একটি লাল বলে পরিণত হয়েছে। তারা পরস্পরের কাছে জানতে চায় একে অপরকে ভালোবাসে কিনা। সামনে যেন তুষারের পর্বত। ‘…ছায়াসুনিবিড় গ্রাম, এলোমেলো নদী, বাঁশপাতার মতো পথঘাট’ সব তুষারে ঢেকে যাচ্ছে। বাঁশপাতার মতো পথঘাট! তুলনাহীন উপমা। রেহমানের কী এইমাত্র বরফে পরিণত হলো? বুকের বাঁ দিকের হৃদয়? হাসিনার নরম কোমল উষ্ণ প্রায় একবছর ধরে চেনা’ বা স্তনটি একান্ত বরফে পরিণত হয়েছে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখল সূর্যাস্তলাল গোলাপগুচ্ছ তুষারস্তূপে পরিণত হয়েছে। কোথা থেকে আসে এ সাদা ধবধবে হিংস্র বিষাক্ত তুষার? এরই মধ্যে হাসিনার ডান স্তনও বরফে পরিণত হয়েছে। চিৎকার করলেও এ দু’টি আর নরম হবে না, সুখ ঢালবে না, মুখের ভেতর ঢুকে পিছলে বেরিয়ে আসবে না।’ রেহমানে পুরুষাঙ্গ বরফের কবজায় চলে গেলো। আমার বুক পর্যন্ত তুষারে ঢেকে গেছে, হাসিনা জানালো। অথচ বাইরে রোদ, আকাশ নয় মেঘাচ্ছন্ন। মধুবাজার প্রায় পৌঁছে আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে হাসিনা দেখলো যে তার কণ্ঠনালিতে তুষার। এই গল্পকার যে একজন যশস্বী কবি তা মনে রাখতেই হবে। ‘তুষার জমেছে-তুষার রেহমানের বুকে, হাসিনার রক্তে, রেহমানের মাংসে, হাসিনার স্বপ্নে…। অথচ যারা প্রকৃতির সন্তান তারা সুস্থ, সুন্দর আছে। যান্ত্রিক, জটিল সভ্যতা তাদের আবেগহীন করতে পারেনি। হাসিনা ও রেহমানের চোখ পুরেপুরি তুষারাচ্ছন্ন হওয়ার আগে তারা দেখল ‘একটা রোদের আড়ালে এক চিলতে রোদে একটি উপজাতীয় তরুণী একটা স্তন ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তার তরুণের বিশাল মুখের ভেতরে।’ মাত্র বত্রিশ বছরের লেখকের কি দুর্দান্ত যাদুকরী গল্প। গল্পটি ১৯৭৯ সালের রচনা।
‘মহান শয়তান’-এর আপেক্ষায় ছিল যেন সবাই। তার আগমনের প্রভাব পড়ে শহরে ও গ্রামে। গ্রামের কিশোর খেজুরগাছ, রাজধানীর অভিজাত অঞ্চলের কিশোরী ও ‘নারায়ণগঞ্জের বেশ্যাপল্লীর এক জীর্ণ কুৎসিত মরণযাত্রী’। লেখকের কলম অমিত শক্তিশালী। কিশোরীর রূপসৌন্দর্যের অপরূপ বর্ণনা পাই আমরা। ‘তার স্তন দুটি কোনো পাপী হাতের পরিচর্যা ছাড়াই বিস্তৃতি পেয়েছে দিগন্তের মতো; নিটোল উচ্চতাও পেয়েছে নীলিমাতুল্য, যাতে পাশাপাশি জ্বলে দুটি অদেখা ধ্রুবতারা।’ মহান শয়তান তার সাথে বয়ে আনে বিকার, তা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। সুন্দরী কিশোরীর প্রায় সবকিছু কুৎসিত আবর্জনায় পরিণত হয়। গাছটি প্রচণ্ড শব্দে দু’ভাগ হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের বস্তিতে ফেলু বেপারী নামের বাতিল, নষ্ট বৃদ্ধ ফিরে পায় কামভাব, তার রক্ত হয়ে ওঠে উজ্জ্বল আর সুস্থ। সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে অশুভ এক অসুখ। ভিলেন পায় হিরো মর্যাদা – ‘ভিলেন আমরা তোমাকেই চাই’, ‘তুমিই মানুষের ত্রাণকর্তা’। একসময় ‘প্রথাসম্মত নাট্যকারের চক্রান্তে বা প্রতিক্রিয়াশীলতার কাছে পরাজয় বইতে থাকে ভিলেনের।’ নায়ক চাষীদের নিয়ে বিদ্রোহ করে তাকে হারায়। কিন্তু অনেক অবোধ মানুষ থেকে যায় ভিলেনেরই ভক্ত। ‘ভিলেনই আমাদের প্রভু’ ‘ভিলেনের জন্য আমরা চল্লিশ বছর শোক পালন করবো।’ মহান শয়তানের পুজা করবে সবাই, ‘তোমার করুণায় আমরা ধন্য।’
১৯৮১ সালের বাস্তবতায় লেখা ‘মহান শয়তান’ অসাধারণ এক গল্প। বিশ্ব-রাজনীতির নিয়ন্ত্রক আমাদের ওপর সামরিকতন্ত্র, প্রতিক্রিয়াশীলতা চাপিয়ে দেন, তাদের অপপ্রচারে আমরা একনায়কতন্ত্র ভালোবেসে ফেলি, নানা চাতুরিতে দেশের মানুষকে বিপথচালিত করে রাখা হয়। বিবেকবান মানুষ তখন অসহায় কোনঠাসা। সেই কঠিন সময়ের অসাধারণ দলিল এই গল্প। জটিল, গভীর, অসাধারণ এক দলিল যা কষ্টের স্মৃতি মনে করায়, ইতিহাসের কালো গহবর চেনায়। প্রতিভাবান এই লেখককে আমরা হৃদয়ের সেরা স্থানে বরণ করে নিই।
‘জঙ্গল অথবা লাখ লাখ ছুরিকা’ আমাদের চারপাশের সামাজিক জঙ্গল ও তার মানুষরূপী জন্তুদের গল্প। এখানেও বেগবান, কাব্যময় গদ্য, অপরূপ বর্ণনা। জঙ্গলে থাকতে হলে প্রয়োজন পড়ে প্রতিরোধের লাখ লাখ ছুরিকা। ‘জন্মের পর চারপাশের সবকিছুই আমার ভালো লেগেছিলো।’‘… ভালো লাগতো বেগুনডালের টুনটুনি দুটিকে; যে গরুটি মাঠে গিয়ে আর ফিরে আসতে চাইতো না, সেটিকে ভালো লাগতো, আমাদের পাশের বাড়ির নতুন বউটি, যে গোশল করতে ঘাটে যাওয়ার সময় আমাকেও নিয়ে যেতো, আমাকে ঘষে ঘষে গোশল করিয়ে দিতো, যে আমাকে লাগিয়ে দিতে বলতো তার ব্লাউজের টিপবোতাম, তার বুক অনেকক্ষণ ধরে দেখতে আমার ভালো লাগতো। আমি যে অনেকক্ষণ ধরে দেখতাম এটাও তার ভালো লাগতো, এবং তাকে আমার তখন সবচেয়ে ভালো লাগতো।’ মধুর শৈশবের অপরূপ বর্ণনা। জঙ্গল সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু জঙ্গল সম্পর্কে ভয় ঠিকই ছিল। ধীরে ধীরে গল্পের কথক বুঝতে শুরু করেন যে তিনি জঙ্গলেই বাস করছেন।‘…আমাকে, এবং আমাদের ঘিরে আছে একটি বড়ো জঙ্গল, তাতে উদ্যত হয়ে আছে জংলি পশুদের থেকেও অনেক হিংস্র অসংখ্য পশুর নখ আর দাঁত।’ বাবাকে মাঝে মাঝে মনে হয় পশু, যদিও তিনি মোটামুটি ভালো মানুষই। মাকে মনে হতো অসহায় পশু আর নিজেদের মনে হতো পশুর বাচ্চা।
বাড়ির বাইরে দেখা মেলে অনেক পশুর। বালকের ধরা মাছ কেড়ে নিয়ে যায় পশ্চিম পাড়ার তোতা মিয়া, যেন একটি শুয়োর। বিনা দোষে মারেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পশুর মতোই। লঞ্চের কেবিন থেকে সুখী বালককে তুলে দেন প্রতাপশালী দারোগা, প্রকাণ্ড শুয়োরের মুখোমুখি কাঁপে বালক। তার লাগানো গাছের লাউ চুরি করে নিয়ে যায় পাশের ভিটের এক জন্তু। গরিব মানুষকে লাথি মারা মামা, শিক্ষক থেকে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হওয়া পশু, ‘চারদিক ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গেছে।’ একের পর এক জন্তুর ফিরিস্তি দিতে দিতে কথক টের পান যে ‘আমার ভেতরে একটি লোহার খনি গড়ে উঠেছে’। এখন জন্তুর আঘাত বিনা প্রতিবাদে তিনি ছেড়ে দেন না, তার চোখে ঝকঝক করে ওঠে রাশি রাশি ছুরিকা। জঙ্গলে বেঁচে থাকার জন্য যা খুর দরকার। বড় হয়ে ‘ছুরিকা চালাতে আমি আর দ্বিধা করিনি।’ জন্তুরা ছুরিকার মুখোমুখি খুব অসহায় বোধ করে। পার্কে প্রেমিকার সাথে পশু দ্বারা আক্রান্ত হলে বেরিয়ে আসে ছুরিকা, বেরিয়ে আসে অফিসে জন্তুর মোকাবেলায়। ‘জঙ্গলে ছুরিকা ছাড়া চলে না।’ গল্পের শেষ বাক্যটি স্মরণীয় হয়ে ওঠে।
‘আমার কুকুরগুলো’ – নারীর ছাত্র জন্তু মোকাবেলার গল্প। ধর্ষক, লম্পটে এখন ছেয়ে গেছে দেশ। ১৯৯৫ সালেও এরা সংখ্যায় কম ছিল না। কি সুন্দর প্রতীকী গল্প এই লম্পটদের নিয়ে। ‘মা বলতো পুরুষ কুত্তার মতো, ওই কুত্তাগুলো থেকে দূরে থাকবি।’ মায়ের কথা মতো নয়, নিজের মনেই মেয়ে দূরে থেকেছেন। কিন্তু দূরে থাকা সম্ভব নয়। ‘কুকুরের মধ্যে বাস করে কুকুর থেকে দূরে থাকা যায় না।’ ‘বালকেরা কুকুর নয়; ওরা খরগোশ বা বেড়াল।’ বড় হয়ে সেই বালকেরই লকলকে জিভ বেরিয়ে আসে, খরগোশ হয়ে যায় কুকুর। স্ত্রী-সন্তান ফেলে অন্য নারীর পেছনে ছোটে। কলেজে পড়ার সময় কুকুররূপী চাচার দেখা মেলে গল্পের নায়িকার। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পথের পাশে একটি দু’টি কুকুর দেখতে পেয়েছি, লালা ঝরতে দেখেছি। কলাভবনে দেখা হয়েছে লম্পট শিক্ষক, কুকুরের সাথে। সবই বাস্তব থেকে তুলে আনা চরিত্র। বুড়ো কুকুরদের দাঁত থাকে না কিন্তু লালা থাকে। আকর্ষণীয়া কিন্তু বিবাহিতা নয়, এমন মেয়ের সমস্যার শেষ নেই। পুরুষ মধ্যবয়সে কুকুর হয়ে ওঠে। তরুণের অসহায়ত্ব কেটে গেলে, গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবয়স্ক মানুষ হয়ে সে দাঁত বের করে। ‘আমার প্রত্যেকটি কুকুর গুরুত্বপূর্ণ।’ ‘… গোশতে একটু কামড় দিতে চায়, তাড়া করলে লেজ উঠিয়ে দৌড়োয়।’ কুকুরের পর কুকুরের সাথে দেখা হয়, আমার কুকুরপাল বাড়ছে।’ বিয়ে করতে সাহস পান না নায়িকা, তার স্বামীও কি একদিন কুকুর হয়ে উঠবে? অবশেষে সিংহের দেখা মেলে, নায়িকা মুগ্ধ হয়, নিজে সমর্পণ করে। ‘কিন্তু সমর্পণ করার পরই দেখতে পাই সিংহটি কুকুর হয়ে উঠছে।’ ‘আমার কুকুরপালে কুকুরের সংখ্য একটি বাড়ে।’
‘যাদুকরের মৃত্যু’ পাঁচটি দারুণ গল্পের একটি অসাধারণ বই। পড়লে ভোলা যাবে না এমন সব গল্প। এক কবি-গল্পকারের অপরূপ সৃষ্টি। আফসোস হয় এই প্রতিভাবান কবি-কথাশিল্পী কেন আরও কিছু গল্প লিখলেন না। পটভূমিকায় বাস্তবকে রেখে এমন মহৎ শিল্পকলা নির্মাণ যাদুকরি দক্ষতাই বটে। মহান এই প্রথাবিরোধী লেখকের অকালপ্রয়াণ কষ্টের স্মৃতি, যা ভোলার নয়।
তারিখ: জুন ৪, ২০২২

 

AstuteHorse