হয়তো কবিতা

আমি বোধহয় সবসময় সাম্প্রদায়িক ছিলাম

 

আমি বোধহয় সবসময় সাম্প্রদায়িক ছিলাম।

ছোটবেলায় আমার আশেপাশে শোনা নামগুলো —

আরতি, শ্যামল, লাবণ্যপ্রভা-কে আমি বাংলা শব্দ ভাবিনি,

ভেবেছি হিন্দুদের নাম।

 

আমি বোধহয় সবসময় সাম্প্রদায়িক ছিলাম।

স্কুলে হিন্দু নামের কোনো মেয়ে পরীক্ষায় প্রথম হলে

আমি ভাবতাম নিশ্চয় ওদের হিন্দু ধর্মের টিচার

ধর্মে ওদের ১০০ তে ১০০ দিয়ে নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছে;

অথবা হিন্দু ধর্মের কেউ অংক বিজ্ঞানে ভালো হলেই

আমি ভেবেছি ওরা তো হিন্দু, ওরা অংকে ভালো হবেই।

 

আমি বোধহয় সবসময় সাম্প্রদায়িক ছিলাম ।

আমার আশে-পাশের অনেক হিন্দু নামের মানুষগুলো যখন

কখনো একা  বা কখনো দল বেধে

ভারতে চলে যাচ্ছিলো

আমি তো একবারও ভাবিনি

“ওরা কেন যাচ্ছে ?” বরং ভেবেছি

ভারতে ওদের আত্মীয়-বন্ধু, জমিজমা, ব্যবসা

কত কী যেন আছে

ওদের তো যাবার-ই কথা।

 

আমি বোধহয় সবসময় সাম্প্রদায়িক ছিলাম ।

না হলে পাহাড়ের ছেলে-মেয়েদের জন্য

বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা থাকার কথা শুনে

আমার কেন গা জ্বলতো ?

কেনো মনে হতো ওরা কিছু না জেনেই

আমার মতো ভালো ছাত্রীর পাশে এসে বসেছে?

 

সবাই যখন নিজেকে অসাম্প্রদায়িক , উদার বলে দাবি করছে,

সবাই যখন হাজার বছরের  বাঙলার  কী যেন কোন

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মন ভুলানো বুলি আওড়াচ্ছে

তখন আমি বলি

আমি বোধহয় সবসময় সাম্প্রদায়িক ছিলাম।

আমি হয়তো প্রতিমা ভাঙিনি

কিন্তু আমি তো হিন্দুদের সব সময়ই হিন্দুই বলেছি।

 

লন্ডন

১৭/১০/২০২১

 

ভালোবাসার নতুন উপমা

 

“বাবা, আমি তোমাকে লবণের মতো ভালোবাসি।”

ভালোবাসার এমন সাদা-মাটা উপমা রাজা মেনে নিলেন না।

অপমানিত বোধ করে প্রিয় মেয়েকে দিলেন কারাবাস।

এই গল্প অনেকে রূপকথায় মুখে-মুখে শুনেছেন বাংলায়।

আর বিশ্ব-জুড়ে অনেকেই জেনেছেন

শেক্সপীয়ারের কিং লিয়ার থেকে।

 

সভা যখন ভাঙলো তখন অবশ্য সবাই এই গভীর সত্য স্বীকার করলো,

“লবণের মতো ভালোবাসাই সত্যি।”

কিন্তু লবণের মতো ভালোবাসার দায়ও বেশি: কম-বেশি হলেই স্বাদ শেষ !

 

আচ্ছা রাজকন্যা যদি রাজাকে বলতেন,

“বাবা, আমি তোমাকে ভাতের মতো ভালোবাসি।”

ভাত —

কৃষক-শ্রমিকের দেহ-শক্তি,

নাগরিক জীবনে এখনো একটুকরো আয়েশি দুপুর,

কিংবা প্রবাসির কাজ শেষে ঠান্ডা ঘরে

এক তৃপ্তির ঢেঁকুর।

কিংবা

হোক না পোড়া-বাসি, একটু ডাল দিয়ে, সাথে পেঁয়াজ-মরিচ . . .

 

রাজা হয়তো একই রকম রেগে যেতেন

রঙহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন, পুষ্টিহীন কি এক চাষার খাওয়া

তার আবার ‘মতো’।

মতো হতেও তো কিছু বিশেষণের ব্যঞ্জনা লাগে !

 

অথবা কেমন হবে যদি প্রেমিক বলে বসেন তার পাশে বসা প্রেমিকাকে:

“আমি তোমাকে ভাতের মতো ভালোবাসি।”

যদি প্রেমিকা হন চিন্তাশীল তাহলে হয়তো জানতে চাইবেন,

“কেমন ভাত? ঐযে ঝরঝরে, দানাদার বাসমতি চালের অ্যাড-টির মতো?”

অবস্থা জটিল হওয়ার  আগেই তৎপর প্রেমিক বলে বসবেন,

“না-না- অতো আর্টিফিশিয়াল না, কিছু শক্ত, কিছু নরম থাকলেও চলবে

আমাদের সম্পর্কের মতো।”

 

প্রেমিকা হয়তো মেনেই নেবেন।

 

কিংবা নতুন দম্পতি যদি জীবনের প্রথম প্রতিজ্ঞা করেন:

“ভাত আমরা দুজনেই রাঁধবো

তুমি শনি, সোম, বুধ,

আর আমি রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি

শুক্রবার তো বাইরে খাওয়া।”

 

কী  জানি আজকাল তো সব উপমাই  টেকে

যদি তা থাকে  ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, আর ইউটিউবের  লাইক আর শেয়ার এ

কিংবা যা  খেতে যেতে হয় গাড়ি করে

দাম দিতে হয় ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড এ

ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জ মিলে যখন হয়ে যায়

গার্মেন্টসকর্মী হ্যাপি বেগমের মাসের বেতন।

 

ভাত ও হয়তো তাই।

 

আমি ভাতকে ভাতের মতোই ভালোবাসি

দিনশেষে একটু ভাতের জন্যই

কখনো হই দেশি, কখনো প্রবাসি।

 

লন্ডন

২০/১১/২০২১

 

সময়

 

যেখানে আগে মায়ের শতছিদ্র শাড়ির মতো বেড়া ছিল

সেখানে এখন মেঘলা রঙের থাই অ্যালুমিনিয়ামের সাইকেল-দরজা।

যেখানে আগে খেলার মাঠ নামে ছিল বাবার মাথার হারিয়ে যাওয়া চুলের

মতো ধুসর ঘাস আর চির ক্ষুধার্ত বাছুর

সেখানে এখন চিকেন-ফ্রাই আর রেড -ভেলভেট কেনাবেচা হয়

নষ্ট এসি-র নিচে।

যেখানে আগে পাঁচশ টাকার ভাংতি নিয়ে নিত্য কথা-কাটাকাটি

সেখানে এখন কার্ড প্লিজ।

তবু এই চোখ বদলায় না

যা শুধু দেখে হিংসা, হানাহানি, ধর্ষণ

আর প্রতিনিয়ত ছোট-বড়র তফাত

 

লন্ডন

৩০/১/২০২২

তারিখ: মে ১৩, ২০২২

প্রকাশক: সাবিহা হক, অধ্যাপক, ইংরেজি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

all rights reserved by - Publisher

Site By-iconAstuteHorse