প্রথম দেখার অনুভূতি

“সে যে কেনো এলো না
কিছু ভালো লাগে না”
সকাল বিকাল করে কতদিন চলে গেলো, তবুও তুমি এলে না? এতো অভিমান কেনো তোমার? সেই কবে তোমাকে আসার জন্য ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েছি তবুও তোমার দেখা নেই। আমার প্রতিটি দিন শুরু হয় তোমার কথা ভেবে। কিন্তু দিন শেষে যখন তোমার আসার কোনো ইংগিত পাইনা তখন আমার ব্যথিত হৃদয় দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খায়।এইতো গতরাতে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কখন যে ক্লান্ত চোখের পাতা বন্ধ হলো বুঝতেই পারলাম না। তুমি ঘুম পাড়ানো পরী হয়ে আমার মাথার পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলে আর গান শোনাচ্ছিলে।তোমার হাতের কোমল স্পর্শে আমার ঘুম ভাঙালে। আমরা দু’জন কংশ নদীর তীরে পূর্ণিমা রাতে নদীর স্রোতের সাথে স্রোতের মধুর মিলন দেখলাম আর জ্যোৎস্না স্নান করলাম।হাতে হাত রেখে নদীতে নাইবো বলে প্রস্তুত হলাম। ‘হঠাত ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ গানের শব্দে ঘুম ভাঙলো। বিচ্ছেদের গান শুনে দিনটি শুরু হলো। রাতের স্বপ্নটা অনেক মধুর ছিলো কিন্তু সকালটা শুরু বিচ্ছেদ দিয়ে। আমি খুব হতাশ হলাম। ভাবলাম সত্যিই তুমি আসবে না। তুমি যদি চিন, যুক্ত্যরাজ্য কিংবা রাশিয়া থেকে আসতে তবুও এতো সময় লাগতো না। আবার ক্ষুদেবার্তা পাঠাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তুমি যদি রাগ করো বার্তা পাঠালে, তাই আর সাহস হলো না। তোমাকে কাছে পাবার ব্যাকুলতা দিন দিন বেড়েই চলছে। মাঝে মাঝে কল্পনা করি তুমি আসলে কোন বাহুতে তোমাকে নিয়ে আলিঙ্গন করবো। একবার ভাবি ডান বাহুতে; পরে ভাবি বাঁ বাহুতেই ভালো হবে। তুমি যেদিন আসবে সে দিন তোমাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হবে। তাই স্থানীয় গুণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তোমার আসার ব্যপারে কথা বলেছি। তুমি আসবে সে বার্তা আমি ইতোমধ্যে সবাইকে পাঠিয়েছি। সবাই তোমাকে একনজর দেখার জন্য অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে।স্থানীয় কলেজ অধ্যক্ষকে তোমার আসার ব্যপারে অবহিত করেছি। উনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন সকল প্রকারের সুযোগ সুবিধা দেবেন। আমরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কলেজের মুক্তমঞ্চেই তোমাকে সংবর্ধনা দেবো। পুলিশ প্রশাসনকেও জানানো হয়েছে। পুরো মঞ্চ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকবে। তুমি আসবে তাই বিজ্ঞ ডাক্তারদেরও আমন্ত্রন জানিয়েছি। তাছাড়া রেডক্রিসেন্ট, স্কাউট , বিএনসিসিসহ সকল সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তোমাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু তুমি কবে আমার কাছে আসবে এই ব্যপারে কেউ সুনিদৃষ্ট ধারণা দিতে পারছে না। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি শুরু হবে শান্তির প্রতীক পায়রা আকাশে উড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে।

এদিকে আরেক মহা কান্ড ঘঠেছে। পায়রা আনার জন্য যে ছেলেটিকে ঠিক করেছিলাম তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেটির বয়স আনুমানিক পনের-ষোল হবে। তার নাম ময়না । গায়ের রঙ শ্যামলা । সে ছোটো থেকেই পাখিদের সাথে খেলা করতে পছন্দ করে। সে পায়রা আনতে বের হয়েছে গত চার-পাঁচ দিন আগে কিন্তু এখনো বাসায় ফিরেনি। ময়নাকে পাঠিয়েছি পায়রা আনতে শুনতে হাস্যকর মনে হলেও এইটাই সত্য। সবাই ধারণা করছে ছেলেটি পায়রার সাথেই উড়ে বেড়াচ্ছে। এই বয়সে অনেকের মনের মধ্যে এদিক ওদিক উড়ে বেড়ানোর শখ উঁকি দেয়। তাই হয়তো সুযোগ পেয়ে পায়রাগুলোর সাথে উড়ে চলে গিয়েছে অজানা কোনো লোকালয়ে। অন্যদিকে ছেলেটির অভিভাবক আমাকে হুমকি দিয়েছে তাকে না পাওয়া গেলে আমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। আমি কিছুটা শঙ্কিত; তবে আশা ছাড়িনি। আমার ধারাণা তুমি আসার আগেই ছেলেটি চলে আসবে। সে আসলে তাকে পায়রা গবেষণা কেন্দ্রে চাকরি দেবো বলে মনস্থির করেছি যেন আর কখনো পায়রা আনতে গিয়ে হারিয়ে না যায়। এইভাবেই নানা জল্পনা কল্পনার মধ্য দিয়ে দিনগুলো অতিবাহিত করছি।

আরেকটি নাটকীয় সকাল! বিছানায় শুয়ে তোমার কথা ভাবছিলাম। তখন কে যেন আমার নামের সাথে সাহেব যুক্ত করে আমাকে ডাকছে। অচেনা কণ্ঠ! তবে আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে কণ্ঠটি কোনো সুন্দরী বালার। আমি বিস্মিত হলাম। মনে মনে ভাবলাম কে হতে পারে এই রমণী? আবার ভেসে আসলো অজানা কণ্ঠ। আমি তার ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠলাম। তারপর কিছুটা অজানা ভয় নিয়ে দরজার খিলটা খুলে দিলাম। খুলতেই দেখি সত্যি সত্যি একটা সুন্দরী রমণী দাঁড়িয়ে আছে । তার ভয়ংকর সুন্দর চোখগুলো ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, “আমার ময়না কোথায়?”

আমি বললাম, “আপনি কে ? আর তোমার ময়না কে?”

আমিতো ময়না পুষি না। মেয়েটি রেগে বললো “ আমি ময়নার গার্লফ্রেন্ড গয়না যাকে আপনি পায়রা আনতে পাঠিয়েছেন। ফিরিয়ে দিন আমার ময়নাকে।”

আমি এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম । ময়নার গার্লফ্রেন্ড গয়না আমাকে হুমকি দিচ্ছে । নিজেকে এই প্রথম ভিলেন মনে হচ্ছে। আমি কি পারবো ময়নাকে গয়নার হাতে তুলে দিতে? মেয়েটিকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে কষ্ট হচ্ছে। নম্রভাবে মেয়েটিকে বললাম তুমি বাসায় যাও। আমি অতি শীঘ্রই ময়নাকে খুঁজে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যাও। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মেয়েটি তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সকালবেলা এরকম একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাতীত। এমনিতেই তোমার আসার কোনো খবর পাচ্ছি না তা নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠায় আছি। এর মধ্যে আবার নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।

সব ঝামেলা শেষ করে যখন স্মার্টফোনটি হাতে নিলাম ঠিক সে মুহূর্তে তোমার আসার ইশারা পেলাম। আমি সেই কবে তোমাকে বার্তা পাঠিয়ে ছিলাম। আর এতো দিন পর তোমার সময় হলো আমাকে রিপ্লাই দেওয়ার? অনেক অভিমান হচ্ছে তোমার উপর। কিন্তু তোমার এসএমএস পেয়ে আমি আবেগাপ্লুত। এতো অপেক্ষার পর তুমি এইভাবে হঠাৎ করে চলে আসার খবর দেবে আমি কল্পনাও করতে পারি নি। তোমার ক্ষুদেবার্তায় আসার দিনক্ষণ সব কিছু জানিয়েছো। কিন্তু যেদিন তুমি আসবে বলে জানিয়েছো সেদিন আমার অফিশিয়াল কাজে ঢাকা যেতেই হবে। এমন একটি দিন আসার জন্য বেছে নিলে যেদিন তুমি আসলে আমি নিজেই তোমাকে দেখতে পারবো না, অন্যরা তো দূরে থাক। তুমি আমার সকল পরিকল্পনায় জল ঢেলে দুঃখের প্লাবন সৃষ্টি করলে। তবে তুমি আমার শহরে আসবে এটা ভেবে কিছুটা শান্তি পাচ্ছি। তুমি যেহেতু আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছো, আমি বাধা দেবো না। আমি যেভাবে তোমাকে বরণ করতে চেয়েছিলাম সেটা আর হলো না। খুব ইচ্ছে ছিলো তুমি আসলেই শ্রদ্ধেয় কবি শহীদ কাদরীর ‘অভিবাদন হে প্রিয়তমা’ কবিতাটি পাঠ করে তোমাকে শোনাবো। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হলো না আমার । যাহোক, তুমি যথা সময়ে এসে আমার শহরকে আলোকিত করবে। অগ্রিম শুভ কামনা রইলো।

নির্ধারিত দিন সে আমার শহরে আসলো । কিন্তু আমি নেই। আমি তখন আমার শহর থেকে প্রায় ১৬২ কিলোমিটার দূরে। আশাহত হৃদয়ে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলাম আমি । মনে চাপা দুঃখ ও অসীম বেদনা নিয়ে তার এই শহরে পদার্পণের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য তারই পাঠানো ক্ষুদেবার্তার একটি প্রিন্টেড ডকুমেন্ট নিয়ে আমাদের নিকটস্ত হাসপাতালে হাজির হলাম। হাসপাতাল গেইটে প্রবেশের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে এই শহরে আমি অভ্যর্থনা না দেওয়ার দরুন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিলো দুঃখ ভোলার জন্য একটা সিগারেট খাই আর জনসম্মুখে ধোঁয়া ছাড়ি। আমার অনেক বন্ধু আবিষ্কার করেছে সিগারেট হচ্ছে দুঃখ ভোলার এক মহৌষধ। তাই আমিও এই ঔষধ সেবন করতে চেয়েছিলাম। যদিও আমি ধূমপানে অভ্যস্ত না । ঐ মুহূর্তে সিগারেট খেতে চাইলে একজন দক্ষ চেইন স্মোকারকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দিতে হতো। যাহোক, প্রবেশের পর লক্ষ্য করলাম কিছুটা ভিড় রয়েছে সেখানে। দুটো সারিতে মানুষ সামনে দৃষ্টি রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক সারিতে নারী ও অন্য সারিতে পুরুষ। আমার কাছে মনে হলো আমি হয়তো ভুল করে কোনো প্যারেড গ্রাউন্ডে চলে এসেছি। আমার ধারণা মিথ্যে হলো কারন ঠিক সেই মুহুর্তে আমার এক বন্ধুর দেখা পেলাম। তার সাথে কুশল বিনিময় করলাম ।আমি এবং সে প্রিন্ট করা ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য পুরুষ সারিতে দাঁড়ালাম। সারিতে দাঁড়ানো অবস্থায় বন্ধুর সাথে খোশগল্প হলো। অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হলো এবং প্রিন্টেড কাগজটি জমা দিলাম। তারপর লক্ষ্য করলাম যাদের ডকুমেন্টগুলো জমা নেওয়া হয়েছে তাদের একজন একজন করে নাম ধরে ডাকছে রেডক্রিসেন্ট এর একজন সেবক। আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলাম নামগুলো। যার নাম ধরেই ডাকা হোক না কেনো আমার কাছে মনে হচ্ছিলো আমাকেই ডাকছে। তাই আমার কানগুলো খরগোশের মতো খাড়া করিয়ে ছেলেটির কথা শুনছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমার নাম শোনা গেলো। অতঃপর আমি তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। রুমের ভিতরে ঢুকে দেখলাম আরও অনেকেই বসে আছে অনেক আশা নিয়ে তাকে বরণ করার জন্য। হঠাৎ একজন সেবিকা ঘোষণা দিলো যে যেই বাহুতে তাকে নিতে চান সেই বাহু প্রস্তুত রাখেন। সেবিকার দিকে একনজর তাকালাম। তিনিও দেখতে বেশ সুন্দরী। তার ঠোটগুলো বাঁকা চাঁদের মতো। ঠোঁটের কোণে হাসি যেন সবসময় লেগেই আছে। তাকে দেখে মানব সেবায় নিয়োজিত যার চেহারা সর্বপ্রথম ভেসে উঠে সবার চোখে সেই মাদার তেরেসার কথা মনে পড়ে গেলো। এতো ভিড়ের মধ্যে তাকে বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ হয়নি। ইতোমধ্যে অনেকেই প্রস্তুত । আবার কিছু মানুষকে দেখে মনে হচ্ছে উনারা রাতে ঘুমাননি তাকে দেখবে বলে। তাদের মধ্যে কারো কারো চোখে মুখে বাধ ভাঙা হাসি ও কারোর চিন্তার ছাপ খেলা করছে। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ হাজির যার জন্য এতো প্রতীক্ষা আর আয়োজন। আমাকে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য সেই সেবিকা ডাক দিলেন। আমি মনের আনন্দে তার সামনে একটা চেয়ারে বসলাম এবং আমার বা বাহু বাড়িয়ে দিলাম তাকে আলিঙ্গন করতে।

তারিখ: নভেম্বর ৯, ২০২১

প্রকাশক: সাবিহা হক, অধ্যাপক, ইংরেজি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

all rights reserved by - Publisher

Site By-iconAstuteHorse