অনুবাদ সাহিত্যের কথা

সব দেশেই অনুবাদ সাহিত্য দাঁড়িয়ে গেছে। সম্মানের আসনে পেয়েছে প্রতিষ্ঠা।

রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন বটে যে অনুবাদে যা হারিয়ে যায়, তা-ই কবিতা। বোধহয় দুর্বল অনুবাদকের বেলায় কথাটি সত্যি। ক্ষমতাবান অনুবাদকের বেলায় নয়। ফ্রস্টের কবিতার চমৎকার অনুবাদ করেছেন শামসুর রাহমান স্বয়ং। কথাশিল্পী রশীদ করিমের অনুবাদও যথেষ্ট মানসম্মত ও সাবলীল। শামসুর রাহমান অনুবাদ করেছেন খাজা ফরিদের কবিতাও।

এর আগে শার্ল বোদলেয়ার অনুবাদ করেছেন বুদ্ধদেব বসু। বাঙালি পাঠক-পাঠিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর। বাঙালি পেয়েছে আধুনিকতার স্বাদ, কবিরা চিনেছেন আধুনিকতার স্বরূপ। বুদ্ধদেব বসু প্রচুর লিখেছেন, প্রচুর অনুবাদও করেছেন। তাঁর বোদলেয়ার-অনুবাদ যুগান্তকারী কাজ। এর আগে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টি এস এলিয়টের কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন, বুঝতে চেয়েছিলেন আধুনিক কবিতা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাফিজ ও নাজিম হিকমত অনুবাদ পেয়েছে সুখ্যাতি।

আজ অনুবাদ সাহিত্য সারাবিশ্বে যেমন, উভয় বাংলাতেই সুপ্রতিষ্ঠিত। ভাবুন একবার, অনুবাদ না হলে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডারের রত্ন সব অচেনাই থেকে যেত আপামর সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে। দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ফিকশন থেকে যেত অচেনা, এর আগে যেমন অনুবাদ না হলে আমরা পড়তে পেতাম না তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, চেখভ বা গোর্কি। পড়তে পেতাম না ফ্লবেয়ার বা মপাসাঁ।

অপরদিকে আমাদের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্প-কবিতা-উপন্যাস অনুবাদের সাহায্য ছাড়া কী করে পৌঁছাত বিশ্ব-দুয়ারে? আজ যে আমেরিকান সাহিত্যের ছাত্র বা ছাত্রী জীবনানন্দ দাশ পড়ছেন তা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? লন্ডনের পাঠক পড়ছেন শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ। কেরালার পাঠিকা পড়ছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। উত্তম অনুবাদই এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। ঢাকায় বসে আমিও পড়ছি ভৈকম মুহাম্মদ বশিরের গল্প বা লাতিন উপন্যাস।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমাদের অনুবাদ সাহিত্য আজ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার সেরা কবি কায়সার হক একজন আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ অনুবাদক। দেশে-বিদেশে তিনি সুপরিচিত ও সুখ্যাত। তাঁর শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীর কবিতার অনুবাদ উচ্চ প্রশংসা পেয়েছে। বিলেত থেকে তাঁর অনুবাদের বই বের হয়, ভারত থেকে হয়। তাঁর বন্ধু অধ্যাপক ফকরুল আলমও একজন সুদক্ষ অনুবাদক। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অনুবাদ করে তিনি জাতিকে কৃতজ্ঞতাভাজন করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ অনুবাদ করে খ্যাতি পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রচুর গানও তিনি চমৎকার অনুবাদ করেছেন। তাঁদের শিক্ষিকা অধ্যাপিকা নিয়াজ জামান খ্যাতিমান অনুবাদক ও সম্পাদক। রাজু আলাউদ্দিন লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের পরিশ্রমী ও আন্তরিক অনুবাদক। উন্নতমানের অনুবাদের কাজ করেছেন ফারুক মঈনুদ্দীন ও মাসরুর আরেফিন। এই সেদিন মশিউল আলমের ফিকশন অনুবাদ করে শ্রীলংকা থেকে পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছেন শবনম নাদিয়া। অল্প হলেও রবীন্দ্রনাথের গল্পের অসাধারণ অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক শওকত হোসেন। তিনি শহীদ কাদরীর কবিতাও অনুবাদ করেছেন। করেছেন হাসান আজিজুল হক ও কাশীনাথ রায়ের গল্প। বাংলাদেশে দক্ষ অনুবাদকের আর অভাব নেই।

অনুবাদকের জগতে অসৎ মানুষ যে নেই তা ঠিক নয়। আছেন অসৎ  প্রকাশক, তাকে সাহায্য করার জন্য অসৎ অনুবাদক। বলা যেতে পারে তারা একে অপরের অপকর্মের দোসর। অন্যের কাজ নিজের নামে চালিয়ে দেন অসৎ অনুবাদক, শুরু আর শেষটা হয়তো একটু পাল্টে নেন। দ্রুত অর্থ আয়ের লোভে অসৎ প্রকাশক এমন কাজে উৎসাহ দেন। কিন্তু এরা দক্ষ অনুবাদক নন, সম্মানিত তো ননই। বাংলাদেশের অনুবাদ-জগতের ক্ষমতাবান কর্মীগণ কোনো অপকর্মের সাথে সম্পর্কিত নন। তাদের দক্ষতা ও আন্তরিকতা দেশে ও বিদেশে প্রশংসা পেয়েছে।

অনুবাদের ব্যাপারে আমার নিজের অভিজ্ঞতা একটু বলি। আমি গল্প-উপন্যাস লিখি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই, প্রবন্ধও লিখি। তাই অনুবাদও করি বাইরের জন্য আমাদের গল্প-কবিতা, আর দেশের পাঠক-পাঠিকার জন্য বিদেশি সাহিত্য। অনেক বছর ধরে লিখি বলে আমার বাংলা ও ইংরেজি উভয় গদ্যই প্রাঞ্জল বলেন অনেকে। বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের কাজ করার দক্ষ লোকের হয়তো একটু অভাব রয়েছে, তাই এই কাজের অনুরোধই বেশি পাই। অধ্যাপিকা নিয়াজ জামানের অনুরোধে সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প অনুবাদ করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সেলিনা হোসেন, ঝর্না রহমান-নূর কামরুন নাহার থেকে তরুণ লেখক-কবি—অনেকের গল্প ও কবিতাই অনুবাদ করেছি। দেশে ও বিদেশে সেই সব অনুবাদ ছাপা হয়েছে। অনুবাদ তরুণ বয়সে অল্প করেছি, এখন প্রবীণ বয়সে ভালোবেসে করছি।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সঠিক শব্দটি খুঁজে নেওয়াই অনুবাদকের জরুরি কাজ। কায়সার হক যেমন বলেন, ইঁদুরকে ইংরেজিতে কি র‍্যাট বলব না মাউস? বুঝতে হবে লেখক বা কবির মুড, সেটি আনতে হবে অনুবাদে। কবি এজরা পাউন্ড যেমন চাইতেন, নিজের সমালোচক-সত্তাকেও জাগ্রত রাখতে হবে, এলার্ট রাখতে হবে। তবেই হয়তো অনুবাদ আর কাশ্মিরী শালের উল্টো পিঠ থাকবে না। হয়ে উঠবে আসল গল্প বা কবিতার মতোই সুস্পষ্ট। হয়ে উঠবে খাঁটি কাশ্মিরী শাল।

আমার নিজের পছন্দ সৃষ্টিশীল লেখকের অনুবাদ। নিজে ভালো কবি না হলে কায়সার হকের শামসুর রাহমান বা শহীদ কাদরীর কবিতার অনুবাদ কি এত ভালো হতো? বলা কঠিন। একই কথা প্রযোজ্য বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার-অনুবাদের বেলায়। মনবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় যে অনুবাদক হিসেবে অপার বাংলায় সুখ্যাতি পেয়েছে, মনে রাখতে হবে তিনি সৃষ্টিশীল লেখক, তার আগে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। আমাদের মশিউল আলম রুশ সাহিত্যের চমৎকার অনুবাদ করেছেন, দস্তয়েভস্কিসহ। তিনি প্রতিষ্ঠিত ফিকশন লেখক। আফসানা বেগমও ভালো কাজ করছেন। আমার ধারণা তার লেখিকাসত্তা তাতে বড়ো ভূমিকা রাখছে। সিনিয়রদের উদাহরণও দেওয়া যায়। শেক্সপিয়রের অনুবাদ আমি পড়তে চাইব সৈয়দ শামসুল হকের হাতেই। সুধীন দত্তও বেশ ভালো অনুবাদ করেছিলেন শেক্সপিয়রের সনেটের।

ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। একজন প্রাজ্ঞ, কল্পনাশক্তিসম্পন্ন, মেধাবী অধ্যাপকও হতে পারেন দারুণ অনুবাদক। উভয় বাংলাতেই এমন আন্তরিক ও পরিশ্রমী অনুবাদক রয়েছেন। আমার প্রিয় শিক্ষকদের কয়েকজনের নাম আমি এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে নিতে পারি।

অনুবাদ শুধু লেখাটির ভাষান্তর ঘটায় না, সেই দেশের সংস্কৃতি ও জনজীবনের চিত্রও তুলে ধরে। হেমিংওয়ে অনুবাদ করতে গিয়ে আমি এক খণ্ড আমেরিকা বা ইউরোপ তুলে ধরি। রবীন্দ্রনাথের গল্প অনুবাদ করতে গিয়ে আমি একশো বছর আগের বাংলাদেশকে তুলে ধরি। তখনকার সমাজ, নারীর জগৎ ও তার সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরি। আবহমান বাংলাকে তুলে ধরি। প্রবাসী বাংলাদেশি লেখকের গল্প বা কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে আমি তার আনন্দ ও কষ্টের জগৎ তুলে ধরি, তার প্রবাসী জীবনের হৃদগ্রাহী চিত্র তুলে ধরি, তুলে ধরি একইসাথে যে দেশে তিনি বাস করছেন সেই দেশকে এবং যেই দেশকে তিনি মিস করছেন তার সেই স্বদেশকে। অনুবাদকের হাতে ভাববিনিময় করে বিভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস।

বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যের জয়যাত্রাই আমার কাম্য। আমি পড়তে চাই জাপান বা চিলির কবিতা ও গল্প। সেইসাথে চাই কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াতে বসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস বা রফিক আজাদের কবিতা পড়ুক তরুণ-তরুণীরা।

 

 

তারিখ: নভেম্বর ১৪, ২০২৩

প্রকাশক: সাবিহা হক, অধ্যাপক, ইংরেজি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

all rights reserved by - Publisher

Site By-iconAstuteHorse